কাতার ক্রিকেট দলে সাতক্ষীরার ইউসুফ

মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার চাপড়া গ্রামে। পারিবারিক টানাপোড়েনে বেড়ে ওঠা এই তরুণ ২০১৭ সালে ভাগ্যবদলের আশায় পাড়ি জমান কাতারে। শুরু করেন হাড়ভাঙা পরিশ্রম।

কাজ করতে থাকেন দৈনিক ১৪ ঘণ্টা। হাল ধরেন পরিবারের। সম্প্রতি কাতার জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পেয়ে আলোচনায় উঠে আসেন ২৪ বছর বয়সী এই তরুণ। চাপ কমে কাজেরও।

বর্তমানে কাতারের ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কন্ট্রাকটিং কোম্পানিতে নিরাপত্তা সহকারী হিসেবে কাজ করা এই তরুণ কেমন করে পেলেন এ সাফল্য, তাঁর আগামীর স্বপ্নইবা কী; চলুন জানা যাক–

কাতারে চাকরি খুঁজছেন? এখানে ক্লিক করুন

গ্রাম থেকে জেলা ও বিভাগ হয়ে ঢাকায়

ইউসুফের খেলার প্রতি আগ্রহ সেই শৈশবের। পরিবারের টানাটানির সংসার সেই আগ্রহে বারবার দেয়াল তুলতে চায়! কিন্তু পারে না। খেলার টানে বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে গিয়ে স্টেডিয়ামে অন্যদের খেলা দেখতেন ইউসুফ।

একদিন তাঁর ওপর দৃষ্টি পড়ে স্থানীয় কোচ মোহাম্মদ লালুর। তিনি নেটে ব্যাট করার সুযোগ করে দেন ইউসুফকে। পাড়াগাঁয়ের ছেলেটার ব্যাটিং স্টাইল ও টেকনিক দেখে চমকে যান কোচ। তখন সাতক্ষীরায় বিভাগীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল। সেই টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় ম্যাচে সুযোগ করে দেন ইউসুফকে।

প্রথম ম্যাচেই হাফ সেঞ্চুরি করে দলকে জিতিয়ে দেন ইউসুফ। সেই টুর্নামেন্ট শেষে সুযোগ পেয়ে যান সাতক্ষীরা ক্রিকেট লিগে। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংও করে অলরাউন্ডার তকমা গায়ে মাখেন ইউসুফ। ভর্তি হন খুলনা মোহামেডানে।

এরপর ঢাকায় প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে সুযোগ পান ২০১৫ সালে। তবে ভাগ্য তাঁকে ফেরায় খুলনায়। খেলতে পারেননি ক্রিকেট। এক সময় পরিবারের হাল ধরতে পাড়ি জমান কাতারে।

কাতারের সব খবর সরাসরি হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন

হাড়ভাঙা পরিশ্রম ও জাতীয় দলের হাতছানি

কাতারে গিয়ে অন্য ৮-১০ জন শ্রমিকের মতো হাড়ভাঙা পরিশ্রম দিয়েই শুরু ইউসুফের। দিনে ১৪ ঘণ্টা রোলার চালাতেন। সারাদিন কাজ শেষে রাত ৮টায় বাসায় ফিরে আবার ভোর ৪টায় কাজে ছুটতেন।

পরিবার ও বন্ধুবান্ধব ভেবেছেন, ক্রিকেটের ভূত এর মধ্যে হয়তো নেমেছে মাথা থেকে। কিন্তু না; উল্টো মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।

তা ছাড়া ইউসুফের থাকার জায়গার কাছাকাছিই কাতার ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। এক সন্ধ্যায় খেলা দেখতে গেলেন স্টেডিয়ামে। ফয়সাল নামের এক খেলোয়াড় তাঁকে খেলার অফার করলেন।

ইউসুফ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। মাঠে নেমেই ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠেন ইউসুফ। ওই দিন প্র্যাকটিস ম্যাচে ৩০ বলে ৬০ রানের পাশাপাশি চার ওভার বল করে নেন তিন উইকেট।

সুযোগ পেয়ে যান দেশটির সি ডিভিশনে খেলার। কিছুদিন পর ইউসুফকে কাতার জাতীয় দলের মোহাম্মদ রিজলান ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার অফার দেন।

গালফার আল মিসনাদ টিমের হয়ে ধারাবাহিক ভালো খেলে কাতার টি১০ লিগে নিজের অবস্থান করে নেন ইউসুফ। ধারাবাহিক ভালো করে ডাক পান কাতার জাতীয় ক্রিকেট দলে।

জাতীয় দলে অভিষেক ও ইনজুরির চোখ রাঙানি

কাতারের হয়ে সবশেষ তিন টি২০-তে খেলে ৫ দশমিক ৪৫ ইকোনমিতে এক উইকেট শিকার করেছেন বাঁহাতি এই স্পিনার। মূলত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইউসুফের অভিষেক হয় কাতার জাতীয় দলে। প্রথম ম্যাচ খেলেন কানাডার বিপক্ষে আইসিসি কোয়ালিফায়ারে।

সেই টুর্নামেন্ট হয়েছিল মালয়েশিয়ায়। দ্বিতীয় ম্যাচে ভানুয়াতুর বিপক্ষে ১০ ওভার বল করে ইউসুফ নিয়েছিলেন এক উইকেট। কিন্তু ফিল্ডিংয়ে গিয়ে হাতে গুরুতর ব্যথা পান। ইনজুরির ছোবলে ছিটকে পড়েন দল থেকে। দীর্ঘ আট মাস মাঠের বাইরে থেকে লিগের মাধ্যমে ফেরেন খেলায়।

দল পান টাইটানস। টাইটানসের হয়ে সাত ওয়ানডেতে ১০ উইকেট নেন, আর তিন টি২০-তে নেন তিন উইকেট। এতে আবার জাতীয় দলে ডাক পড়ে ইউসুফের।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার চাপড়া গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইউসুফের। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই খেলতে চলে যেতেন। এ জন্য মায়ের বকুনি আর বাবার পিটুনিও কম খাননি।

কিন্তু বিকেলে পাড়ার মাঠে খেলা শুরু হলে ইউসুফকে আটকায় সাধ্য কার? ভালো ব্যাটিং করতেন, সঙ্গে উইকেটকিপিংও। স্বপ্ন দেখতেন একদিন বড় ক্রিকেটার হবেন।

আগামীর স্বপ্ন

আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে ইউসুফ বলেন, ‘ছোটবেলার স্বপ্নটা দেখি এখনও। দিন দিন সেই স্বপ্ন যেন আরও বড় হচ্ছে। কাতার জাতীয় দলে খেললেও আমার মন পড়ে আছে বাংলাদেশে। আইসিসির র‍্যাঙ্কিংয়ে কাতারের অবস্থান ২৩, বাংলাদেশের ৯।

আগামীতে আমি লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়িয়ে নিজের দেশের হয়ে খেলতে চাই– এ স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই দেখছি।’ দেশ ও দেশের বাইরে থাকা এমন স্বপ্নবাজ তরুণদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে লাল-সবুজের
বাংলাদেশ!

আরও পড়ুন ..

সমকাল

Loading...
,