চাকরিচ্যুতির শঙ্কা হাজারো প্রবাসীর

সরকার উদ্যোগ নিলেও হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর যন্ত্র (দ্রুততম সময়ে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা) বসাতে আরও সময় লাগবে।
দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে প্রথমবারের মতো এ ধরনের যন্ত্র বসানো এবং সেটি পরিচালনা করা একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি রয়েছে অভিজ্ঞতারও অভাব।
যদিও দেশেরই কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর যন্ত্র বসাতে আবেদন করেছে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান শুধু সরকারি অনুমোদন ও স্থাপনা তৈরির সুবিধা চেয়ে আবেদন জানিয়েছে।
দ্রুততম সময়ে যন্ত্রটি বসানোর কাজ শুরুর আগ্রহ প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি অনেক আগেই অনুমতি চেয়ে আবেদন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। কিন্তু তাতে শিগগিরই সায় মিলছে না।
এদিকে দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে আরটি-পিসিআর ল্যাব না থাকায় ছুটিতে দেশে এসে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) কয়েক হাজার প্রবাসী।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে সরকার আরটি-পিসিআর মেশিন কেনার উদ্যোগ নিলেও সেটি সময়সাপেক্ষ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার চাইলে মাত্র তিন দিনেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর যন্ত্র বসিয়ে দ্রুততম সময়ে আটকেপড়া প্রবাসীদের ফেরত পাঠাতে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আটকেপড়া আরব আামিরাত প্রবাসীদের ফিরে যাওয়ার স্বার্থে আমি দ্রুততম সময়ে বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর মেশিন বসানোর জন্য সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।
এমনকি ইতিমধ্যে আমি একটি সুনির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি। তবে আমার প্রস্তাব থাকবে আমিরাত সরকারের শর্ত যারা পূরণ করতে সক্ষম আপাতত তাদের বিবেচনায় নেওয়া।
তারপর বাকি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে। শিকদারসহ কয়েকটি কোম্পানি আবেদন করে এই মেশিন বসানোর আগ্রহ দেখিয়েছে। যারই সক্ষমতা বেশি, তাকেই অনুমতি দিয়ে দেওয়া উচিত।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে এসে আটকেপড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসীদের বিষয়টি বিবেচনা করে বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর যন্ত্র বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।
এ জন্য গত বুধবার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর মেশিন বসানোর জন্য দুটি কমিটি করে দেওয়া হয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে দুটি কমিটি করা হয়েছে।
এ দুটি কমিটি মেশিন স্থাপন এবং এ ক্ষেত্রে কাদের সক্ষমতা আছে তা নিয়ে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন তৈরি করবে। মেশিন স্থাপনের সক্ষমতা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের আছে তা দেখবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিটি এবং স্থাপনের বিষয়টি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কমিটি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরর একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারিভাবে র্যাপিড আরটি-পিসিআর টেস্ট মেশিন বসানোর সম্ভাবনা নেই। কারণ এটি একটি দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়া।
তাই বেসরকারি কোম্পানিকে সেখানে মেশিন স্থাপন এবং টেস্টের জন্য নিয়োগ দেওয়া হবে। বেসরকারিভাবে যারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান, তাদের মধ্য থেকে কাউকে দেওয়া হবে।
এ ক্ষেত্রে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। যারা আবেদন করবেন তাদের মধ্য থেকে সক্ষমতা যাচাই করে কাউকে অনুমোদন দেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী যেসব বাংলাদেশি দেশে এসে আটকা পড়েছেন তাদের ফিরতে হলে অবশ্যই আরটি-পিসিআর টেস্ট করাতে হবে।
এটা আরব আমিরাত সরকার আরও অন্তত দিন দশেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে। তারপরও সেই মেশিন বসানো সম্ভব হয়নি। এতে অনেকের ভিসার মেয়াদ চলে গেছে।
আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এই মেশিন বসানো না গেলে আরও অনেকেই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে চাকরি হারাবেন। তখন এ নিয়ে তো হইচই হবে। অথচ আরটি-পিসিআর বসানোর জন্য দেশের বেসরকারি শীর্ষ স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি শিকদার গ্রুপের পক্ষ থেকে সক্ষমতা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে আবেদন করা হয়েছে।’
সরকার শুধু অনুমোদন দিলে আরব আমিরাত সরকারের শর্তানুযায়ীই মাত্র ৪-৫ দিনের মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর মেশিন বসানো সম্ভব উল্লেখ করে আশীষ রায় চৌধুরী বলেন, ‘কিন্তু সরকার এখন যে প্রক্রিয়ায় তা সমীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও দরপত্র ডাকাসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে যাচ্ছে, তাতে শিগগিরই এটা বসানো সম্ভব হবে না।
আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে যেহেতু বেসরকারিভাবেই আরটি-পিসিআর মেশিন বসানোর মূল সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, তখন আর বাকি প্রক্রিয়ায় এত সময় নষ্ট করা কিছুতেই প্রবাসীদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, ‘আরটি-পিসিআর টেস্ট ল্যাব বসানোর বিষয়ে সরকার খুবই তৎপর। যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে তা নিয়ে কাজ চলছে।’
জানা গেছে, আরব আমিরাত সরকারের নির্দেশনায় বিপাকে আছেন প্রায় ২০ হাজার প্রবাসী। বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা না থাকলে দেশটিতে পাঁচ দেশের নাগরিকরা প্রবেশ করতে পারবেন না।
এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। আমিরাত এয়ারলাইনস জানিয়েছে, বাংলাদেশ ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছে নাইজেরিয়া, ভিয়েতনাম, জাম্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। এসব দেশের যাত্রীদের নিজ দেশের বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা না থাকায় বর্তমানে আরব আমিরাত ভ্রমণ সম্ভব নয়।
দুবাইভিত্তিক এয়ারলাইনসটির সর্বশেষ ট্রাভেল আপডেটে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। আগে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা কয়েকটি দেশের নাগরিকদের চলতি সপ্তাহে ভ্রমণ ভিসা ও এন্ট্রি পারমিট দেওয়া শুরু করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
এয়ারলাইনসটির নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, আরব আমিরাতের নির্দেশনা অনুযায়ী ভ্রমণে বাধা থাকা দেশগুলো কভিড-১৯ টেস্টের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তাদের নাগরিকরাও দেশটিতে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন।
বেবিচকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, প্রায় তিন মাস ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞার পর গত ৪ আগস্ট বাংলাদেশসহ ছয় দেশের যাত্রীদের ট্রানজিট সুবিধা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে ফ্লাইট ছাড়ার ৬ ঘণ্টার মধ্যে র্যাপিড পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ রিপোর্টপ্রাপ্ত যাত্রীরা আরব আমিরাতে প্রবেশ করতে পারবেন বলে শর্ত দেওয়া হয়।
যদিও সেখানে গিয়ে আরও একবার যাত্রীদের করোনা পরীক্ষা করা হবে। আর এই শর্তে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ছুটিতে দেশে ফেরা কয়েক হাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী। বর্তমানে কমপক্ষে ৬ হাজার প্রবাসী কাজে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। দ্রুত সমস্যার সমাধান না হলে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে কাজ হারাবেন তাদের অনেকেই।
দ্রততম সময়ের মধ্যে দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে র্যাপিড পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন আরব আমিরাতপ্রবাসীরা। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধনও করেছেন তারা।
প্রবাসীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছেন। দ্রততম সময়ের মধ্যে দাবি বাস্তবায়নের জন্য ফের মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
বেবিচকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এমন পরিস্থিতিতে বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে গত ২৩ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমরা এখনো চিঠির জবাব পাইনি। অনুমতি পেলে প্রয়োজনে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে র্যাপিড পিসিআর ল্যাব বসাব।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সাংবাদিকদের জানান, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিঠি পৌঁছেছে। কিন্তু এ ধরনের মেশিনের স্পেসিফিকেশন অধিদপ্তরের কাছে নেই।
তাই মেশিন কেনার জন্য দরপত্র দেওয়া, ক্রয় প্রক্রিয়া ও স্থাপন করা সব মিলিয়ে এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। হয়তো খুব দ্রুত সম্ভব হবে না, তবে যেকোনো উপায়ে হলেও এই যন্ত্র সংগ্রহ করা হবে। একটু সময় লাগবে।
আর এরই মধ্যে বিমানবন্দরে সাইট সিলেকশন হয়ে গেছে। এখন আর্কিটেকচারাল স্ট্রাকচার বানানোর কাজ চলছে।
