টিকার ব্যয় পদ্মা সেতুর সমান

দেশের ৮০ শতাংশ লোককে দেয়ার জন্য টিকা কিনতে যে টাকা লাগবে, তা পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয়ের প্রায় সমান।
সরকার এ অর্থের জোগাড়ের যে পরিকল্পনা করেছে, তাতে সিংহভাগ আসবে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে। এ অর্থ ঋণ হিসেবে নেয়া হবে, যার কোনো কোনোটি শোধ দিতে লেগে যাবে ত্রিশ বছর।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা কিনতে অর্থায়নের একটি পরিকল্পনা করেছে সরকার। দুই বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনায় টাকা কোথায় থেকে আসবে এবং কীভাবে ব্যয় করা হবে সে বিষয়ে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে।
আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ লোককে করোনা প্রতিরোধে টিকা দেবে সরকার।
হিসাব কষে দেখা গেছে, এতে মোট ব্যয় হবে ৩৭০ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী, যার পরিমাণ ৩১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, এটি পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয়ের প্রায় সমান।
সরকার এ বিপুল অর্থের জোগান দেবে কোথা থেকে?
সরকারের পরিকল্পনায় এর সিংহভাগ আসবে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে। সহায়তার পরিমাণ হবে ২৯৫ কোটি ডলারের বেশি। অবশিষ্ট টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।
জুলাইয়ের শেষে অর্থায়নের পরিকল্পনা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে উপস্থাপন করেছে সরকার। কীভাবে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে, কত টিকা লাগবে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে পরিকল্পনায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ম্যানিলাভিত্তিক বহুজাতিক ঋণদানকারী সংস্থা কাছ এডিবির কাছ থেকে। সংস্থাটি দেবে সর্বোচ্চ ৯৪ কোটি ডলার।
এরপর রয়েছে বাংলাদেশের অপর উন্নয়ন সহযোগী ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক। তারা দেবে ৫৫ কোটি ডলার। এ ছাড়া চীনের নেতৃতাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংক বা এআইআইবি অর্থায়ন করছে ৫০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অপর উন্নয়ন অংশীদার জাপানের জাইকা দিচ্ছে ৩৫ কোটি ডলার। এর বাইরে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা দিচ্ছে ৬১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
সব মিলিয়ে টিকা কিনতে উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অবশিষ্ট টাকা বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে এডিবি তাদের বোর্ড সভায় ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
এ ঋণের সুদ হার হবে ২ শতাংশ এবং ২০ বছরে পরিশোধ যোগ্য। ‘রেসপনসিভ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কর্মসূচি’র আওতায় এডিবি এ ঋণ দিচ্ছে বাংলাদেশকে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুত ঋণের সুদ হার ধরা হয়েছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং পরিশোধ করতে হবে ত্রিশ বছরে।
বিশ্বব্যাংকও তাদের বোর্ড সভায় ঋণ প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়েছে। দুই ধাপে এই ঋণ দেয়ার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়েরে এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চলতি মাসের শেষে অথবা আগামী মাসে জাইকা ও এআইআইবি তাদের অর্থ ছাড় করবে।’
পর্যায়ক্রমে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরাও অর্থ ছাড় করবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, ‘সবাইকে টিকার কার্যক্রমের আওতায় আনাই হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ।’
সরকারের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সরকার প্রতি মাসে কমপক্ষে ১ কোটি ২০ লাখ লোককে টিকা দেয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১৩ কোটি ৮২ লাখ লোককে টিকা দেয়া হবে।
অর্থাৎ দেশের ৮০ ভাগ লোককে টিকার আওতায় আনা হবে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে গরিব দেশগুলোর জন্য ন্যায্যতার ভিত্তিতে টিকা বিতরণে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম ‘কোভ্যাক্স’ এর কাছে ৭ কোটি ৬৭ লাখ ডোজ টিকা অনুদান হিসেবে দেয়ার কথা। এর মধ্যে পাওয়া গেছে ১ লাখ ৬১ হাজার ডোজ ফাইজারের টিকা।
সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের আরও বলেছে, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হওয়ায় চীন ও রাশিয়াসহ অন্যান্য বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে চীন থেকে ৩ কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে সরকার। এর মধ্যে দুই চালানে দেশে আসছে ৫০ লাখ টিকা। এছাড়া উপহার হিসেবে আর ১১ লাখ টিকা দিয়েছে চীন।
সব মিলিয়ে চীন থেকে সিনোফার্মের ৬১ লাখ টিকা দেশে আসছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আরও ৩০ লাখ টিকা দেশে আসার কথা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের বাইরেও করোনা টিকা কিনতে আলাদা ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সোমবার চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান সিনোফার্ম থেকে করোনার টিকা কিনতে ২৬৭ কোটি টাকা অর্থ ছাড় করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা। এ লক্ষ্য অর্জনে থোক বরাদ্দের ১০ হাজার কোটি টাকা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বরাদ্দের ৫ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হলে টিকা কেনার পেছনে ব্যয় করা হবে।
তারা আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতে টাকার কোনো সমস্যা হবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যখন যা চাইবে, চাহিদা অনুযায়ী অর্থ ছাড় করা হবে।
