প্রবাসীদের বহির্গমন ছাড়পত্র পেতে হয়রানি-বিশৃঙ্খলা

প্রবাসীদের বহির্গমন ছাড়পত্র পেতে রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের প্রতিনিধিরা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত পরশুও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এর সাথে ছিল বিশৃঙ্খলা। এ সময় ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স করাতে আসা অনেকেই যথাসময়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরকে টেবিলে না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
কেউ কেউ বলছিলেন, সময়মতো স্মার্ট কার্ড না পেলে তাদের কর্মীর ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে। বর্তমানে প্রতিদিন দুই হাজারেরও বেশি প্রবাসী কর্মীর নামে বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানী কাকরাইলের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে দিনভর খোঁজ নিয়ে পাওয়া যায় এমন চিত্র।
দুপুর ১২টা। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অভ্যন্তরে দেখা যায় বহির্গমন শাখার নিচতলার গেটের সামনে ভিড় করে আছেন বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের নিয়োজিত প্রতিনিধিরা।
তাদের কারো হাতে পাসপোর্ট আবার কারো কাছে বহির্গমন ছাড়পত্র নেয়ার কাগজপত্র। গেটের পাশে কর্মচারী সমিতির অভ্যন্তরে সৌদিগামী প্রবাসীদের অনুবাদ করানোর কার্যক্রম চলছে। সেখানে কিছুক্ষণ পরপর প্রতিনিধিরা ভিড় জমান।
অপর দিকে বহির্গমন পরিচালকের দফতরে ছাড়পত্রের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে প্রত্যেক এজেন্সি প্রতিনিধিকে সকালে ফাইল জমা হওয়ার পরই বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয়।
বেলা ৩টার আগে কেউ যাতে আবার দোতলার বহির্গমন শাখায় ঢুকতে না পারেন সেজন্য নিচতলা এবং দোতলার গেটের সামনে বসানো হয় স্টাফ পাহারা।
দেখা যায়, বহির্গমন শাখার কর্মচারী কিছুক্ষণ পর পর বাঁশি বাজিয়ে অহেতুক ভিড় করা লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছেন। দোতলায় দেখা গেছে, পরিচালক, উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকরা তাদের কাজ করছেন।
বেলা ১টার দিকে এক কর্মকর্তার (ডিডি) টেবিলে প্রবাসীদের ফাইলের স্তূপ জমে থাকে। প্রবাসী এক কর্মীর একটি ফাইলে কিছুটা সমস্যা হওয়ার কারণে তিনি ডাকলেন তার অধীনস্থ সহকারী পরিচালককে (মহিলা)। এ সময় ওই নারী কর্মকর্তার সামনে তিনি কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে থাকেন, ‘এভাবে কাজকর্ম হলে আমি রিজাইন দিয়ে চলে যাবো।’ ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা হয়ে কাজ করতে চাই না।
তখন ওই নারী কর্মকর্তা তার সাথে জি স্যার জি স্যার বলে বলতে থাকেন, ঠিক আছে স্যার এখন থেকে যেকোনো বিষয়ে ভেবেচিন্তে তারপর ফাইলে সই দেবো বলে রুম থেকে বের হয়ে নিজ টেবিলের দিকে চলে যান। ততক্ষণে বেশ কিছু এজেন্সি মালিকের প্রতিনিধি যথাস্থানে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরকে না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন।
কেউ কেউ রুম খালি থাকায় নিজের হাতে তাদের ফাইলে সিল মেরে অন্যত্র নিয়ে যেতে দেখা যায়। কেউ বলছিলেন, কয়েক ঘণ্টা হয়ে গেল স্যার আসছেন না। যদি আজকে ফাইল সই না হয় তাহলে কিন্তু আমার কর্মীর ফ্লাইট মিস হয়ে যেতে পারে। তখন কর্মকর্তার স্টাফ খালি রুমে প্রতিনিধিদের শান্ত করার চেষ্টা করেন।
একপর্যায়ে পরিচালক (বহির্গমন) তার রুমে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ডেকে নেন। এরপর প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক। এ সময় নিচতলায় অপেক্ষমাণ এজেন্সি প্রতিনিধিরা উঠে পড়েন দোতলায়। তাদের আটকাতে সেখানকার গেটের সামনে টেবিল দিয়ে পথ বন্ধ করা হয়। তারপরও লোকজন হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে থাকেন।
ব্যুরোর নিচতলায় আল ইতসাল নামক একটি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রতিনিধির কাছে ভিড় হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা শুধু সৌদি আরবে নারী ও পুরুষ শ্রমিক পাঠানোর কাজ করি। এ কারণে প্রতিদিন এখানে আমাদের আসতে হয়। কিন্তু সময়মতো কাজ না হওয়ার কারণে আমাদের অনেক হয়রানি হতে হয়।
আমাদের অনেক কর্মীর ফ্লাইটও মিস হয়ে যায় কখনো কখনো। রাব্বী নামে অপর একজন প্রতিনিধি জানান, এখানে কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যার মতো যা মন চায় তাই করে। ফাইলে নিজেই নিজের সিল মারেন। এসব নিয়ন্ত্রণে আসা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
সন্ধ্যার পর জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (বহির্গমন) হাসান মাহমুদ বলেন, আমার অফিসের সামনে কোনো হইচই হয়নি। আপনার রুমে কর্মকর্তাদের নিয়ে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় মিটিং করেছেন।
কোনো সমস্যা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না তো কোনো সমস্যা হয়নি। এরপর তিনি বলেন, এজেন্সির প্রতিনিধিরা প্রতিদিন আমার অফিসে আসে। নিচে বসার জায়গা না থাকার কারণে লোকজন এসে দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কোনো এক কর্মকর্তার পরিচিত প্রবাসী কোনো এক কর্মীর ফাইলে সই দেয়া নিয়ে সমস্যা হওয়ার কারণে কর্মকর্তারা পরিচালকের রুমে আলোচনায় বসেছিলেন বলে ব্যুরোর দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, করোনা মহামারী কেটে যাওয়ার পর প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সৌদি, দুবাই কাতার ও ওমানসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানো কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্রের কাজ হচ্ছে ব্যুরোর বহির্গমন শাখায়। এতে প্রতিদিন এ শাখায় চাপ বাড়ছে। এই সুযোগে পুরনো সিন্ডিকেট নানা কৌশলে তাদের ফাইল ছাড় করানোর চেষ্টায় তৎপর।
