বাংলাদেশ থেকে ১১শ কোটি টাকা বিদেশে পাচার

বিদেশ থেকে আনা বিভিন্ন পণ্যের অর্থ পরিশোধের আড়ালে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের সত্যতা পেয়েছে পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা জমা দেওয়ার পর রহস্যজনকভাবে সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে ওই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচারের অভিযোগ উঠেছে।
কাতারের সব খবর হোয়াটসঅ্যাপে পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
সিআইডি সূত্র জানায়, এ চক্রের মূল হোতাসহ দুজনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রাথমিক তদন্তে প্রায় ৪৬ কোটি ২ লাখ ১৭ হাজার ১২৫ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচারের প্রমাণ মিলেছে।
এ চক্রের আরও ১২ সদস্য পলাতক। সিআইডির তদন্তে চক্রের মূল হোতা মেসার্স আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মালিক খন্দকার আশফাক হোসেন কাদেরীর নাম উঠে আসে।
তার সঙ্গে ছিলেন তার চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট সুশান্ত নাথ। সুশান্ত চায়না সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এ চক্রের অন্য যে ১২ জন রয়েছে তাদের মধ্যে একজন জালাল দুবাই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।
আরেকজন হলেন হারুন। তিনি সৌদি আরবের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।
সিআইডি সূত্র জানায়, এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা চীন, দুবাই ও সৌদি আরবে মোটা অঙ্কের অর্থ পাচার করেছে।
কাতারে চাকরি খুঁজছেন? এখানে ক্লিক করুন
চক্রের সবাইকে গ্রেফতার করতে পারলে অর্থ পাচারের সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। এরই মধ্যে কাদেরী ও তার সহযোগীকে জিজ্ঞাসাবাদে অর্থ পাচারের লোমহর্ষক তথ্য পাওয়া গেছে বলে সিআইডি সূত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মো. বাছির উদ্দিন বলেন, দীর্ঘ তদন্তের পর অর্থ পাচারের অভিযোগে ১৪ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কাতারের সব খবর হোয়াটসঅ্যাপে পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
তাদের মধ্যে দুজনকে এক দিনের রিমান্ডে এনে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা পাচারের সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত এবং চিহ্নিত আসামিদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলছে।
এর সঙ্গে আর কারও সম্পৃক্ততা পেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি আরও বলেন, অবৈধ লেনদেনকারী ও অর্থ পাচারকারীদের খুঁজে বের করা হচ্ছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, মেসার্স আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মালিক খন্দকার আশফাক হোসেন কাদেরী ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
এর মধ্যে ৭টি অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে ২০২২ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। এসব অ্যাকাউন্টে ১ হাজার ৮৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে।
এ অর্থ পুরোটাই হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা সিআইডির।
কাতারে চাকরি খুঁজছেন? এখানে ক্লিক করুন
ওই সূত্র আরও জানায়, আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানি ও বিকাশ এজেন্টের মধ্যে ই-মানি লেনদেন বাবদ অ্যাকাউন্টে জমা হলেও ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যতা খুঁজে পেয়েছে সিআইডি।
দীর্ঘ তদন্তের পর চলতি বছরের ৩ মে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগ। মামলার বাদী হন পরিদর্শক কেএম রাকিবুল হুদা।
আসামি আশরাফ হোসেন কাদেরী ও তার সহযোগী সুশান্ত নাথসহ ১৪ জন। পরে আসামি কাদেরী ও সুশান্তের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন চট্টগ্রাম সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত।
কাতারের সব খবর হোয়াটসঅ্যাপে পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
এরপর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন তারা। গত ১৫ জুলাই ওই মামলায় হাজিরা দিতে গেলে আদালত কাদেরী ও সুশান্তকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন আদালত।
এর আগে কাদেরী ও সুশান্ত নাথকে এক দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা দুজনই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির নামে ট্রেড লাইসেন্স নিলেও ২০১৯ সালেই হুন্ডি ব্যবসা শুরু করেন কাদেরী।
এই প্রতিষ্ঠান ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৪টি অ্যাকাউন্টের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
তার মধ্যে ৭টি অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয় ১ হাজার ৮৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে পাচারের প্রমাণ পায় ৪৬ কোটি ২ লাখ ১২৫ টাকা।
কার মাধ্যমে কত টাকা পাচার : মামলায় উল্লেখ করা হয়, কাদেরী চক্রের সদস্য জামাল হোসেনের কর্মচারী শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা, আতিকুর রহমানের কর্মচারী বাবুল আহমেদের ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, আবদুল্লাহ আল নোমানের কর্মচারী ফারুকের ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা, মানিক মিয়ার ৬২ লাখ টাকা, রাশেদুল হক রাসেলের কর্মচারী ওমর কাইয়ুমের ৩৫ লাখ টাকা, সজীবের কর্মচারী ওমর কাইয়ুমের ৫৮ লাখ টাকা, শিমুল উদ্দিনের দেড় কোটি টাকা, শিকদার বনি আমীনের ১ কোটি ৬ লাখ টাকা, মেরাজুল ইসলামের ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকা, মাসুদ মীরের কর্মচারী উজ্জল মিয়ার ২৬ লাখ টাকা, আশরাফুল আলমের কর্মচারী সাজ্জাত হোসেনের ৩ কোটি ৪ লাখ টাকা, আলাউদ্দিন আবিদের ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকা, রাহাত কবিরের কর্মচারী সুবর্ণ আহমেদের ২৭ কোটি ২২ লাখ টাকা।
কাতারে চাকরি খুঁজছেন? এখানে ক্লিক করুন
যেভাবে শুরু হুন্ডি ব্যবসা : এজাহারে মামলার বাদী উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালে বিকাশ লিমিটেডের ডিস্ট্রিবিউটর মেসার্স আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মালিকের বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, উষ্ণ ডিস্ট্রিবিউটরশিপের নামে বিভিন্ন তফসিল ব্যাংকে পরিচালিত চলমান ৭টি হিসাবের কেওয়াইসি, হিসাব খোলার পর ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে ১ হাজার ৮৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা জমা এবং প্রায় সমপরিমাণ অঙ্কের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
কাতারের সব খবর হোয়াটসঅ্যাপে পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
মেসার্স আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির এজেন্টদের মধ্যে ই-মানি লেনদেন বাবদ এসব হিসাবে টাকা জমা হওয়ার বিষয় থাকলেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড় অঙ্কের টাকা জমা করেছে।
মেসার্স আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির অধিক্ষেত্র চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের চকবাজার ও কোতোয়ালি থানা এলাকা হলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে মেসার্স আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির বিকাশ ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে টাকা জমা করে।
এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রামের ওআর নিজাম রোডের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের শাখাতেই ৪০৯ কোটি টাকা জমা দেওয়ার পর সমপরিমাণ টাকা উত্তোলন করে।
কে কী ব্যবসা করতেন : সিআইডির অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, আসামি জালাল হোসেন দুবাইয়ের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তিনি মেসার্স আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে হুন্ডি করে বিদেশে মুদ্রা পাচার করেছেন।
আসামি মো. আবদুল্লাহ আল নোমান স্টিল শিট আমদানি করে লোকাল বাজারে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। তিনি বিদেশ থেকে বেশি মূল্যে স্টিল শিট কিনে এলসিতে কম মূল্য দেখিয়ে আমদানি করে বাকি টাকা আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে হুন্ডি আকারে বিদেশে মূল্য পরিশোধ করেন।
কাতারে চাকরি খুঁজছেন? এখানে ক্লিক করুন
আসামি মো. শিমুল উদ্দিন মোতালেব প্লাজায় যাওয়া-আসা করতেন এবং তিনি অবৈধভাবে চায়না থেকে মেমোরি কার্ড নিয়ে আসার পেমেন্ট আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে হুন্ডি করে বিদেশে পাচার করেন।
আসামি মো. আতিকুর রহমান বর্তমানে কারাগারে থাকা সুশান্ত নাথের সহযোগিতায় লাগেজ ও প্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা মোবাইলের মূল্যের (আইফোন, স্যামসাং, ওয়ান প্লাসসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামি মোবাইল) আড়ালে কাদেরীর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হুন্ডি করে বিদেশে পাচার করেন।
আসামি মো. রাশেদুল হক ওরফে রাসেল লাগেজ পার্টির কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামি ফোন নিয়ে সেই অর্থ হুন্ডি আকারে কাদেরীর মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেন।
কাতারের সব খবর হোয়াটসঅ্যাপে পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
এ ছাড়াও আসামি সজীবের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও লাগেজ পার্টির কাছ মোবাইল ফোন ক্রয়-বিক্রয় করে আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে হুন্ডি করে বিদেশে অর্থ পাচার করেন।
আসামি মো. আবু খায়ের নয়ন নবাবপুর এলাকার পেশাদার আমদানিকারক। তিনি সব ধরনের হার্ডওয়্যার ও টুলস আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি করেন।
তিনি বিদেশ থেকে পণ্য আনার জন্য মেসার্স আল কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে হুন্ডি করে বিদেশে মুদ্রা পাচার করে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করেন।
একইভাবে কাদেরীর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন সৌদি প্রবাসী হারুনের কর্মচারী এহসান, ইব্রাহিম ট্রেডিংয়ের মালিক ইব্রাহিমের কর্মচারী মো. মাইন উদ্দিন, শিকদার বনি আমিন, মো. মেরাজুল ইসলাম, মো. কামরুল হাসান মজুমদার।
আরও পড়ুন
গালফ বাংলা
