সোনা পরিশোধনের যুগে বাংলাদেশ

বসুন্ধরা গোল্ড রিফাইনারি ইতিমধ্যে কারখানা স্থাপনের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক সম্মতিপত্র পেয়েছে। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডও করতে চায়।

সোনা পরিশোধনের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য কারখানা তৈরি হতে যাচ্ছে দেশে। অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির পর তা কারখানায় পরিশোধনের মাধ্যমে সোনার বার ও কয়েন উৎপাদন করা হবে। সেগুলো রপ্তানির পাশাপাশি দেশে অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত হবে। পাশাপাশি অলংকার রপ্তানির সুযোগও তৈরি হবে।

দেশে অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির সুযোগ দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত মাসে স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ সংশোধন করেছে। সেই আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার সোনা পরিশোধনের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে সোনা আমদানির অনুমতি নেবে, সে বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির নেতারা বলছেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ গত বছর সোনা পরিশোধনের কারখানা স্থাপনের অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। এরপরই মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয় এবং স্বর্ণ নীতিমালা সংশোধন করে। ইতিমধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপ সোনা পরিশোধনাগার স্থাপনে প্রাথমিক সম্মতিও পেয়েছে। এ ছাড়া ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডও কারখানা স্থাপনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে।

জানা যায়, অপরিশোধিত সোনা পরিশোধনের জন্য বসুন্ধরা গোল্ড রিফাইনারি লিমিটেড নামে নতুন কোম্পানি খুলেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। ইতিমধ্যে কোম্পানিটি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সদস্যপদও নিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পরিশোধন কারখানা স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। অনুমোদনের শর্তানুযায়ী, নির্ধারিত স্থানে সোনা পরিশোধনাগার স্থাপন করতে হবে।

অন্যান্য সব ধরনের লাইসেন্সের পাশাপাশি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকার অনুমোদিত ব্যবসায়ী সংগঠনেরও বৈধ সদস্য হতে হবে।

অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানকে অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করতে হবে।

এ জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের কাগজপত্র, হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন সনদ, মূসক নিবন্ধন, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্যপদের কপি, প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জীবনবৃত্তান্ত, পরিশোধনাগারের নির্ধারিত স্থানের মালিকানার দলিল ইত্যাদি জমা দিতে হবে। অনুমতি ফি বাবদ ৩০ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। অনুমোদনের মেয়াদকাল হবে পাঁচ বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে আবারও তা নবায়ন করতে হবে।

জুয়েলার্স সমিতির নেতারা জানান, পরিশোধন কারখানা স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিমানবন্দরের ৮-১০ কিলোমিটারের মধ্যে ২০ বিঘা জমি থাকতে হবে। তা ছাড়া বন্ড লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তিসহ সরকারের বেশ কয়েকটি দপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।

জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ‘আধুনিক মানের পরিশোধন কারখানা স্থাপনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ দরকার। তবে বসুন্ধরা কত টাকা বিনিয়োগ করবে, সেটি আমার জানা নেই।’

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা আরও বলেন, কঙ্গো, মালি ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে অপরিশোধিত সোনা আমদানি করা যাবে। তবে পরিশোধিত সোনায় কী রকম শুল্ক ও কর আরোপ করা হবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

বিদেশ থেকে অপরিশোধিত সোনা দেশে এনে পরিশোধনের বিষয়টি আমাদের জন্য একেবারেই নতুন।

সংশোধিত স্বর্ণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিশ্বে অলংকার উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং ভারত, চীন অন্যতম।

২০১৯ সালে বিশ্বে মেশিন ও হাতে তৈরি সোনার অলংকারের বাজার ছিল ২২ হাজার ৯৩০ কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২৫ সালে আকার বেড়ে ২৯ হাজার ১৭০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে।

সুনির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও দেশে বছরে প্রায় ২০-৪০ মেট্রিক টন সোনার চাহিদা রয়েছে। তার মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা পুরোনো অলংকার দিয়ে মেটানো হয়। বাকিটা ব্যাগজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে আসে।

অবৈধভাবেও বিপুল সোনা আসে। তাই সোনার বাজার ও জুয়েলারি ব্যবসায় স্বচ্ছতা ফেরাতে ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে সোনা আমদানির লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে আমদানি পর্যায়ে উচ্চ শুল্কের কারণে প্রথম ছয় মাস সোনা আমদানি করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। গত ২০২০–২১ অর্থবছরের বাজেটে ২০ শতাংশ কর প্রত্যাহার করা হয়।

এরপর ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড দুবাই থেকে ১১ হাজার গ্রাম সোনা আমদানি করে। এরপর আরোসা গোল্ড করপোরেশন ১৫ হাজার গ্রাম সোনা আমদানি করে।

একাধিক প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও সোনার মান যাচাইয়ের অজুহাতে কয়েক মাস আমদানি বন্ধ থাকে। গত ছয় মাসে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড ১০০ কেজি সোনা আমদানি করেছে। আরেকটি প্রতিষ্ঠান এনেছে ১০ কেজি সোনা।

এরপরও আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশের বাজারে সোনার দাম তুলনামূলক বেশি। এ জন্য সোনার বৈধ আমদানিতে শুল্কসহ অন্যান্য খরচকে দুষছেন ব্যবসায়ীরা।

দেশের বাজারে বর্তমানে ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ৭১ হাজার ৯৬৬ টাকা। যদিও গত বছরের শুরুর দিকেও দাম ছিল ৬০ হাজার ৩৬১ টাকা ভরি।

সোনা পরিশোধনের কারখানা স্থাপনের বিষয়ে জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, সোনা পরিশোধন শুরু হলে দেশের ভেতর থেকেই বৈধভাবে সোনা কেনার সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভোক্তারাও উপকৃত হবেন। এ ছাড়া সোনার অলংকার রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হবে।

Loading...
,