কাতারের প্রকৌশলী সমাজের প্রিয় মুখ আব্দুল আওয়াল (খোকন) আর নেই

দীর্ঘ এক যুগ পর কাতার ছেড়ে আমার দ্বিতীয় আবাস সিডনী ফিরে এসেছি বছর তিনেক হল। গতকাল হঠাৎ করে কাতার প্রবাসী প্রিয়জন ও অনুজ প্রকৌশলী আব্দুল আওয়ালের না ফেরার দেশে পাড়ি দেয়ার সংবাদ শুনে চমকে উঠেছি, হয়েছি চরম শোকাহত। পৃথিবীতে কোনো কিছু চিরস্থায়ী নয়, সেটা আমরা জানি।

কিন্তু কাছের কোনো মানুষের চলে যাওয়াটা অনেক সময় মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও অমরা ভুলে যাই, আমাদের এই পরিচিত পৃথিবীটা কতটা ভঙ্গুর, কতটা ঠুনকো।

গতকাল সোমবার ১৩ মার্চ সকাল ১০.৪৫ টায় কাতারের হামাদ হাসপাতালে শেষ নি:শ^াস ত্যাগ করেছে আব্দুল আওয়াল।

ড. বসুনিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে হামাদ বিমানবন্দরে আওয়াল (আমার ডান পাশে)

ব্রাহ্মনবাডিয়ার নবীনগর থানার বিটঘর গ্রামের সন্তান আব্দুল আওয়ালের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, কাতারে চাকুরীরত এবং বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে প্রশিক্ষণে আছে। একমাত্র মেয়ে বর্তমানে কানাডায় কর্মরত। ছোট ছেলে কাতারে পড়াশুনা করছে।

আব্দুল আওয়ালের সাথে আমার প্রথম দেখা সেই আশি দশকের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^ বিদ্যালয়ের (চুয়েট) ক্যম্পাসে। আওয়াল আমার পরের ব্যাচের (১০ম) সিভিলের ছাত্র ছিল।

সেই হিসাবে আমার সাথে অগ্রজ-অনুজের একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল। ১৯৮৪ সালে সিভিল ইঞ্জনিয়ারিং পাশ করার পর পরই ১৯৮৫ সালে জীবিকার সন্ধানে আওয়াল পাড়ি জমায় কাতারে।

প্রায় একই সময়ে আমিও দেশ ছেড়ে প্রবাসে চলে গেলে ওর সাথে যোগাযোগ মোটামুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু ২০০৮ সালে সিডনী থেকে কাতার গিয়ে আওয়ালের সাথে আবার দেখা হয় দোহা শহরে। অওয়াল একজন স্বল্পভাষী, সজ্জন মানুষ। দেখা হবার পর স্বভাবসুলভ মুদু হেসে আমাকে স্বাগত জানায়।

প্রকৌশলী আওয়াল – ইঞ্জিনিয়ার্স ডে ২০১৬ (বাম থেকে পঞ্চম)

আওয়াল প্রথম জীবনে চাকুরী করলেও পরে একটি কন্ট্রাকটিং কোম্পানী চালাতো। কাতারের ওল্ড সালাতা এলাকার বিখ্যাত ক্রেজি সিগন্যালের কাছেই ছিল তাঁর হার্ডওয়্যার ও বাড়ী-ঘর নির্মাণ সামগ্রীর একটি দোকান ও অফিস। ওর অফিসে বসে কথা হল দীর্ঘক্ষণ।

কাতারে আসার পর প্রতিক‚লতার মুখে সাঁতার কেটে তাঁর আজকের অবস্থানে আসার বহু গল্প শোনালো আমাকে। পরিচয় করিয়ে দিল স্ত্রী, পুত্র, ও কন্যার সাথে।

আওয়াল একজন পরোপকারী মানুষ ছিল। বিশেষ করে নতুন কোনো প্রকৗশলী কাতারে আসলে তাঁর জন্য চাকুরী ও আবাসস্থল খুঁজে দেয়ার জন্য আপ্রান চেষ্টা করত। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউশন অফ ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইবি) কাতার চ্যাপ্টারের আশ্রয়স্থল ও ভরসার হাত ছিল আব্দুল আওয়াল।

কাতার চ্যাপ্টার প্রতিষ্ঠার পর থেকে অর্থ, শ্রম দিয়ে এই সংগঠনের জন্য নিরলস কাজ করে গেছে আওয়াল। আইইবির বড় বড় অনুষ্ঠানে খাবারের আয়োজন করার মত কঠিন দায়িত্বটা বরাবর আওয়ালে কাঁধে এসে পড়তো এবং যা সব সময় হাসিমুখে করে যেতো।

প্রকৌশলী আওয়াল – ইঞ্জিনিয়ার্স ডে ২০১৭ (শেষ সারিতে বাম থেকে ৪র্থ)

২০১৪ সালে আইইবি কাতারের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেবার পর দীর্ঘ চার বছর খুব কাছে থেকে আমি দেখেছি এই প্রতিষ্ঠানের জন্য আওয়ালের মমত্ববোধ কতটুকু। কাতারে আমাদের সংগঠনের কোনো স্থায়ী অফিস ছিলনা। তাই ওর নিজের অফিসটাই আমাদের মিটিং করার জন্য খুলে দিয়েছিল।

সময় অসময়ে আমরা ওর অফিসে বসেই আইইবির কাজ করেছি। মিটিং চলাকালীন আবার চা-নাস্তারও আয়োজন করতো। আইইবি কাতারের কাজ করতে যেয়ে ক্রেজি সিগন্যালের কাছের আওয়ালের অফিসে যে কত সময় কাটিয়েছি, সবাইকে নিয়ে হৈ হুল্লোড় করেছি তার ইয়াত্তা নেই।

কেনো জানিনা ফেলে আসা বহু স্মৃতিকথা আজ আমাকে বড্ড তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হয়েও কখনো পদের জন্য লালায়িত না হয়ে কার্যকরী কমিটির একজন সাধারণ সদস্য হিসাবে আওয়াল দীর্ঘদিন কাজ করে গেছে।

এ নিয়ে কথা তুললে আওয়াল বলতো, আমি পদ চাইনা, কাজ করেই আনন্দ পাই। আওয়াল ছিল একজন সাদা মনের মানুষ। প্রকৌশলী সমাজ নিয়ে রাজনীতি, কিংবা প্রকৌশলীদের মধ্যে বিভক্তি আসুক এমন কাজ থেকে সবসময় দূরে থাকতো।

প্রবাসী কল্যান মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে প্রকৌ: আওয়াল (বাম থেকে ১ম)

তবুও কেনো জানিনা, নির্বাচনের সময় কাতার আইইবির কিং মেকাররা আওয়ালকে আইইবির কার্যকরী পরিষদের উপরের কোনো পদে বিবেচনা কথা কৌশলে এড়িয়ে যেতেন। ২০১৭ সালে আমার চার বছরের চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হলে ২০১৮ সালের আইইবি কাতার নির্বাচনী কমিশনের একজন সদস্য হবার সুযোগ হয়।

সেবারই আওয়াল আইইবি কাতারের ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়।

আওয়াল তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে সবসময় ভাবতো। কানাডা কিংবা আমেরিকায় সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে আমার কাছে সবসময় পরামর্শ চাইতো। আমির যতদূর সম্ভব এ বিষয়ে আমি তাঁকে পরামর্শ দিতাম। আওয়াল একজন সফল বাবা। আওয়ালের সন্তানরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে এখন কর্মরত।

২০২০ সালের আগস্ট মাসের কথা। আমি কাতার ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কোভিড মহামারীতে তখন বিশ^জুড়ে চলছে লকডাউন। প্রায় বিচ্ছিন্ন সবার সাথে যোগাযোগ।

পরে জানতে পারি কোভিডের সময় থেকেই আওয়ালের কিডনী সমস্যার শুরু। পরবর্তীতে সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস করতে হোতো। শেষ পর্যন্ত এই কিডিনী জটিলতার কারণেই নিভে গেলো আওয়ালের জীবন প্রদীপ।

কোভিডের কারণে কাতার ছেড়ে আসার আগে ওর সাথে শেষ দেখাটাও হলনা। আওয়াল, পরপারে তুমি ভালো থেকো, জান্নাতুল ফেরদৌসে হোক তোমার আবাস, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সেই প্রার্থনাই করছি।

আরো পড়ুন

Loading...
,