কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চ্যাট-জিপিটি : লাভক্ষতির উপাখ্যান

২০২৩ সালকে বলা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারিক প্রসারের বছর। জানুয়ারিতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে চ্যাট-জিপিটি নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট।

গত বছরের নভেম্বরে উন্মুক্ত হবার পর মাত্র দুই মাসের মধ্যে ১০ কোটিরও বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী পেয়েছে চ্যাট-জিপিটি।

কাতারের সব খবর হোয়াটসঅ্যাপে পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন

জনপ্রিয় ভিডিও বিনিময়ের নেটওয়ার্ক টিকটক চালুর ৯ মাস পর এ মাইলফলক অর্জন করেছিল। আর তাই চ্যাট-জিপিটিকে বর্তমানে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ভোক্তা অ্যাপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

ইতোমধ্যে মাইক্রোসফট হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে মাইক্রোসফট। সুতরাং, বুঝাই যাচ্ছে পুঁজিবাজারের আকর্ষণীয় পণ্যের কাতারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমনী বার্তা।

প্রযুক্তির আসন্ন সময়কে ধারণা করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বর্ণযুগ হিসেবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে লাভ-ক্ষতি বিবেচনার জন্য আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের অনেক হিসেব-নিকেশের মধ্যদিয়ে যেতে হবে।

প্রথমেই- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে ধারণা থাকা সমীচীন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে যন্ত্র বা অ্যাপ্লিকেশনকে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির আদলে কাজের উপযোগী করে তোলে।

একজন মানুষকে নিয়েই যদি চিন্তা করি, মানুষকে বিশ্লেষণ করা হয় মূলত তার ব্রেইন দিয়েই।

মানুষের ব্রেইন যেভাবে কাজ করে, কম্পিউটারকে বানানো হয়েছে ঠিক সেভাবেই। তার হিসেব করার ক্ষমতা আছে, মেমোরি আছে, স্টোরেজ আছে।

সেই স্টোরেজ থেকে ডাটা নিয়ে সে বিভিন্ন রকমের প্যাটার্ন বের করতে পারে। একটি ছোট শিশু যেমন তার মায়ের চেহারা দেখে বা কথা শুনেই তাকে চিনে ফেলতে পারে, ক্রেতা যেমন পণ্য দেখেই অভিজ্ঞতা দিয়ে আঁচ করতে পারে গুণগত মান, ঠিক তেমনি একটি কম্পিউটার তার পুরোনো ডাটা থেকে প্যাটার্ন বের করে অনেক কিছুই অনুমান করতে পারে।

চ্যাট-জিপিটি আসার পর সাধারণ মানুষ উপলদ্ধি করতে পারছে, কম্পিউটার এখন মানুষের মতো করেই ডাটা প্রসেস করতে পারে।

খুব সম্ভবত, প্রথমবারের মতই সাধারণ মানুষ বিচলিত বোধ করছে কিংবা আশায় বুক বাঁধছে মানুষের মত যন্ত্রের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে।

তাইতো, চ্যাট-জিপিটি মাত্র দুই মাসে দশ কোটি গ্রাহক পেয়ে গেছে। মজার কথা হচ্ছে, চ্যাট-জিপিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শুরুর একটি স্মার্ট চ্যাটবট।

ভবিষ্যতে, দক্ষ, অভিজ্ঞ, পরিশ্রমী মানুষের ব্রেইনের মত সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত চ্যাটবটসহ কৃতিম বুদ্ধিমত্তার আরো অনেক স্মার্ট সমাধান আসবেই এবং আসা শুরু হয়েছে।

ইতোমধ্যে প্রথিতযশা ডাক্তার, সাংবাদিকরা চ্যাট-জিপিটির কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে মত দিয়েছেন, তাদের পেশাগত দক্ষতার অনেকাংশই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই চ্যাটবট আয়ত্বে নিয়েছে।

দক্ষ সাংবাদিকের চার-পাঁচ দিনের কাজ চ্যাটবট কয়েক সেকেন্ডে করে দিচ্ছে। সম্প্রতি, মার্কিন কংগ্রেসের চেম্বারে প্রথমবারের মতো চ্যাট-জিপিটি থেকে প্রাপ্ত বক্তব্য পাঠ করা হয়েছে।

কর্মসংস্থানে চ্যাট-জিপিটি তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিরকম প্রভাব ফেলবে তার একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এর কলাম লেখক হেনরি উইলিয়ামসের অভিজ্ঞতা থেকে।

সম্প্রতি তিনি চ্যাট-জিপিটিতে লেখেন, ‘হোয়াট ইজ পেমেন্ট গেটওয়ে’ বা ‘পেমেন্ট গেটওয়ে কী’।

তাঁর ভাষ্য হলো, উত্তরে চ্যাট-জিপিটি যে নিবন্ধ লিখে দিল, তা দেখে চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। নিবন্ধের বক্তব্য চিত্তাকর্ষক।

ব্যাকরণ ও বাক্যগঠন একদম যথাযথ, যদিও লেখার মধ্যে যান্ত্রিকতার ছাপ আছে, কাঠামো কলেজ পর্যায়ের প্রবন্ধের মতো পরিশীলিত। তবে কিছুটা ঘষামাজার পর সেই যান্ত্রিকতাও দূর করা গেল।

যে নিবন্ধ লিখে তিনি ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত আয় করেন, সেই নিবন্ধ চ্যাট-জিপিটি ৩০ সেকেন্ডে লিখে দিল। এর সীমাবদ্ধতা আছে, শব্দবহুল বাক্য লেখার প্রবণতার সঙ্গে অনেক সময় ভুল তথ্য দেওয়ার প্রবণতাও তার আছে।

কিন্তু কোম্পানি যদি দেখে এই প্রযুক্তির সাহায্যে ২০ জনের কাজ ১০ বা ৫ জন দিয়ে করানো সম্ভব, তাহলে এই প্রযুক্তি গ্রহণ করতে তারা দ্বিধা করবে না, এটাই পুঁজির ধর্ম।

পুরো বিশ্ব এখন-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলতে যেহেতু চ্যাট-জিপিটিকেই বুঝছে, চ্যাট-জিপিটি নিয়েই হিসেব করা যেতে পারে।

চ্যাট-জিপিটির মত চ্যাটবট নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে। যেমন-

চ্যাট-জিপিটির মত চ্যাটবট কাস্টমার বা গ্রাহক সেবা চব্বিশ ঘণ্টাই চালাতে পারবে এবং সকল ধরনের প্রশ্নোত্তর, সমস্যার সমাধান মানুষের চেয়ে নির্ভুলভাবে দিতে পারবে।

এতে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ যারা কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসে মেধা রফতানি করছে, এই কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে চলে যেতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মেশিন পৃথিবীর অনেক ডাক্তারের চেয়ে ভালো রোগী দেখে দিতে পারবে। ইতোমধ্যে চ্যাট-জিপিটি অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতই পরামর্শ দিতে সক্ষম হচ্ছে।

এর মাধ্যমে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের প্রান্তিক রোগীদের কাছে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া যাবে।

সম্প্রতি সত্য নাদেলা (মাইক্রোসফট সিইও) ভারতের প্রান্তিক কৃষকদের প্রয়োজনে চ্যাট-জিপিজি কিভাবে সহযোগিতা করেছে, প্রকাশ করেছে।

যদি তাই হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে কৃষক দ্রুত, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। বিকাশ-রকেট দোকানের মত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাপোর্ট সেন্টার আইডিয়া নিয়ে অনেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা উদ্যোগ নিতে পারেন, একদম প্রান্তিক-নিরক্ষর লোকদের সেবা দিতে।

বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাখাত উপকারিতার চেয়ে মানুষের মেধা ব্যবহারের কমতির ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। শিক্ষকরা যদি এই প্রযুক্তির সাথে পরিচিত না হন, তাহলে পুরো একটি জেনারেশন কিছু না পড়েই পাশ করে আসতে পারবে।

পাশাপাশি নকল করে যারা বাচ্চাদের বই লিখেছিলেন, তাদের কাজও কমে যাবে। এরপর আর তাদেরকে নকলের দোষ দেয়া যাবে না।

তবে এতদসত্ত্বেও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিজস্ব কোন আবেগ নেয়। যারা এলগরিদম লিখছেন, তাদের ব্যক্তিগত বায়াসডনেস, অভিমত দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে অনেক সিদ্ধান্ত যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

কর্মসংস্থানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেমন প্রভাব ফেলবে, সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল স্বয়ং চ্যাট-জিপিটিকে। ‘তুমি কি মানুষের চাকরি খেয়ে ফেলবে?’

জবাবে চ্যাট-জিপিটি যা লিখল তার সারসংক্ষেপ এমন, ‘আমি একধরনের ভাষা মডেল। আমার নিজের পক্ষে এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা নেই বা এ বিষয়ে মত দেওয়ারও আমি কেউ নই।

তবে ধারণা করা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের সঙ্গে এবং বিভিন্ন শিল্পে অটোমেশন হলে অনেক মানুষ চাকরি হারাবে। আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় অনেক নতুন চাকরির সৃষ্টি হবে।

সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থানে এর প্রভাব সরলরৈখিক হবে না, বিষয়টি জটিল। বিষয়টি নির্ভর করবে সরকারের নীতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ওপর।’

নতুন প্রযুক্তি নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে। প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসের (পিডব্লিউসি) ভবিষ্যদ্বাণী, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে বৈশ্বিক জিডিপিতে ১৫ লাখ কোটি ডলার যুক্ত হবে।

ইতোমধ্যে ৩ শতাংশ কাজ ঝুঁকির মুখে আছে। তবে ২০৩০ সালের মধ্য দশকের মধ্যে এই অনুপাত ৩০ থেকে ৪৪ শতাংশে উঠে যাবে, বিশেষ করে স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রে; অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক মানুষকে হয় দক্ষতার উন্নয়ন করতে হবে, না হয় কাজ ছেড়ে দিতে হবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক, জাতীয় কনভেনশন করাটা জরুরি। আমাদের দেশের আইনপ্রণেতাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আলোচনা করার সময় এসেছে যাতে নীতিমালা নিয়ে আসা যায় এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা প্রযুক্তিকে মাথায় রাখা হয়।

আরো পড়ুন

গালফ বাংলা

Loading...
,