কুয়েতের ওয়ার্ক ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত ৩০০ ডলার পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে
Loading...

কুয়েতের ওয়ার্ক ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত ৩০০ ডলার পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে
কুয়েত দূতাবাস অন্তত ১০টি সংস্থাকে ভিসা প্রক্রিয়ার জন্য অনুমোদন দিয়েছে। এসব সংস্থা অতিরিক্ত চার্জের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কাতারে বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন চাকরির খবর
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে অনুমোদিত কিছু নিয়োগকারী সংস্থা অতিরিক্ত চার্জ আদায় করায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীদের কুয়েতের কর্মসংস্থান ভিসার জন্য গড়ে ৩০ হাজার টাকা বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
Loading...
শুধু এ অতিরিক্ত চার্জই নয়, অবৈধ ভিসা বাণিজ্য ও উচ্চ বিমান ভাড়াসহ বিভিন্ন কারণে অভিবাসন ব্যয় সরকার নির্ধারিত ১ লাখ ৬ হাজার টাকার তুলনায় পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা, ক্ষতিগ্রস্ত কর্মী ও নিয়োগকারী সংস্থাগুলো।
ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকায় কুয়েত দূতাবাস-অনুমোদিত সংস্থাগুলো ভিসা প্রক্রিয়াকরণের জন্য অতিরিক্ত ১৫০ থেকে ৩০০ ডলার (১৭ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা) চার্জ করছে, যদিও সরকারি ফি মাত্র ৬ হাজার ২৭০ টাকা।
এ বিষয়ে কুয়েতগামী এক কর্মীর আত্মীয় মো. সাইফুল ইসলাম খান ২৮ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ দাখিল করেন।
‘আমার ভাগ্নে ভিসা প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রায় ৩৩ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন, যা নির্ধারিত খরচের পাঁচ গুণ বেশি। বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে চাকরি পাওয়া এমনিতেই ব্যয়বহুল, তার ওপর এ অতিরিক্ত ফি আরও বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে,’ টিবিএসকে বলেন সাইফুল। তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়েও এ বিষয়ে একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
কাতারের সব আপডেট হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন
Loading...
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জমা দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার বাংলাদেশি কর্মী কুয়েতে গেছেন, যাদের কাছ থেকে আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৭ মিলিয়ন ডলার আদায় করা হয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কুয়েতে পাচার হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
যদিও কর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে বা কোনো সংস্থার মাধ্যমে চাকরির চাহিদাপত্র সংগ্রহ করতে পারেন, তবে তাদের ভিসা প্রক্রিয়াকরণ অনুমোদিত সংস্থাগুলোর মাধ্যমেই করতে হয়। সাধারণত কর্মীরা মোট অভিবাসন ব্যয় কোনো সংস্থা বা মধ্যস্থতাকারীকে প্রদান করেন, যারা পরে অনুমোদিত সংস্থার মাধ্যমে ভিসা প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন।
একটি অননুমোদিত নিয়োগকারী সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালিক টিবিএসকে বলেন, ‘গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর অনেক সিন্ডিকেট ভেঙে যায়, তাদের কর্মকর্তারা পলাতক হয়ে যায়। তবে কিছু সিন্ডিকেট আরও সক্রিয় হয়ে কুয়েতগামী অভিবাসীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৩০০ ডলার আদায় করে চলেছে।’
তিনি দাবি করেন, গত বছরও অনুমোদিত সংস্থাগুলো প্রতি ভিসায় অতিরিক্ত ৪৫ হাজার টাকা চার্জ করেছিল।
Loading...
এর আগে সৌদি আরবে ওয়ার্ক ভিসা প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরনের অভিযোগ উঠেছিল। টিবিএসের জুলাই ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি প্রকাশ পায়, যার পর ২০২৩ সালের মার্চে সৌদি কর্তৃপক্ষ ১৫৪ কোটি টাকার ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে প্রাক্তন দূতাবাস কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
অনুমোদিত সংস্থাগুলোর অস্বীকার
কুয়েত দূতাবাস অন্তত ১০টি সংস্থাকে ভিসা প্রক্রিয়ার জন্য অনুমোদন দিয়েছে। এসব সংস্থা অতিরিক্ত চার্জের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
টিবিএসের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এসবি ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী কামাল শিকদার বলেন, ‘গন্তব্য দেশই সিদ্ধান্ত নেয় কোন সংস্থা ভিসা প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকবে, তাই আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুযোগ নেই।’
আরেক অনুমোদিত সংস্থা মডার্ন ওভারসিজের স্বত্বাধিকারী আবদুস সালাম আরেফ বলেন, বর্তমানে ১৪-১৫টি সংস্থা ভিসা প্রক্রিয়ার অনুমতি পেয়েছে। জনশক্তি ইমিগ্রেশন কার্ড চার্জ, মজুরি উপার্জনকারীদের ফি ও অন্যান্য সার্ভিস চার্জের কারণে মোট ব্যয় নির্ধারিত ফি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
Loading...
তিনি কুয়েতগামী কর্মীদের ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করার অভিযোগ নাকচ করে বলেন, ‘আমি জানি না কেউ এত টাকা পরিশোধ করেছে কি না।’
কুয়েত দূতাবাসের নীরবতা
২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর টিবিএস কুয়েত দূতাবাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা জাভেদ করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রশ্ন জমা দেওয়ার জন্য একটি ইমেল ঠিকানা ([email protected]) দেন। তবে একই দিনে প্রশ্ন পাঠানো হলেও শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
জাভেদ করিম জানান, তিনি ইমেলটি সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠিয়েছেন। তবে, পরবর্তীসময়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানান।
ভিসা প্রক্রিয়ার অন্ধকার দিক
‘ভিসা ট্রেডিং’—যেখানে মধ্যস্থতাকারীরা নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে চাহিদাপত্র সংগ্রহ করে তা উৎস দেশগুলোর নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করে—এখনও ব্যাপকভাবে চলছে। ফলে চাকরিপ্রার্থীদের বিদেশে কাজের জন্য অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
Loading...
নিয়োগকারীদের মতে, দূতাবাস কর্তৃক জারি করা ভিসার জন্য অতিরিক্ত অর্থ আদায় এখন অবৈধ চুক্তির নতুন কৌশল হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত ফি পরিশোধ করার পরও অনেক কর্মী ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
গত বছরের ২৩ অক্টোবর কুয়েতে পৌঁছানো বাংলাদেশি অভিবাসী আলম ভূঁইয়া এমনই এক সমস্যার মুখে পড়েন।
‘আমি কুয়েতের অয়েল আল নাসিফ কোম্পানিতে এসেছিলাম। আমার চিকিৎসা ও অন্যান্য কাগজপত্র ঠিকঠাক ছিল। আমি বাংলাদেশি একটি এজেন্সির মাধ্যমে এসেছিলাম। কিন্তু যখন পৌঁছাই, তখন কোম্পানির অফিস থেকে জানানো হয়, আমার ভিসা জাল। তারা বলে, আমার ভিসার জন্য আরও টাকা বাকি আছে এবং ওই টাকা ব্রোকারকে দিতে হবে, নাহলে আমাকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে,’ কুয়েতে বাংলাদেশিদের একটি ফেসবুক গ্রুপে উল্লেখ করেন আলম ভূঁইয়া।
‘আমি তাদের বললাম, আমি পুরো টাকা পরিশোধ করেছি। এরপরও তারা আবার ফোন দিয়ে জানায়, আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে,’ তিনি আরও বলেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) প্রাক্তন মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘বিভিন্ন শ্রমবাজারে এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম চলে আসছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত করা যে কোনো সংস্থা যেন অতিরিক্ত ফি আদায় করতে না পারে।’
Loading...
ভিসা কারসাজির সিন্ডিকেটে প্রভাবশালীরা
ভিসা কারসাজির সিন্ডিকেটে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কুয়েত এখন অবৈধ ভিসা বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহীদ ইসলাম ওরফে কাজী পাপুল এ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন।
২০২১ সালে আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্যকে আরও চারজনের সঙ্গে কুয়েতে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ ও নিজের কোম্পানির জন্য চুক্তি পেতে কুয়েতি কর্মকর্তাদের লক্ষ লক্ষ ডলার ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ছিল।
২০২০ সালের ৬ জুন কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ পাপুলকে গ্রেপ্তার করে এবং তার বিরুদ্ধে মানব পাচার, অর্থ পাচার ও কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ আনে। অভিযোগ রয়েছে, তার সহযোগীরা উচ্চ বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিটি অভিবাসী কর্মীর কাছ থেকে ৫-৭ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করত।
বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্তে দেখতে পায়, পাপুল, তার পরিবার ও সহযোগীরা বাংলাদেশ থেকে ৩৮ কোটি ২২ লাখ টাকা পাচার করেছেন। আর ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এ অর্থের পরিমাণ বেড়ে ৩৫৫ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে সিআইডির ধারণা।
Loading...
বাংলাদেশিদের জন্য কুয়েত ষষ্ঠ বৃহত্তম গন্তব্য
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) অনুসারে, কুয়েত বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ষষ্ঠ বৃহত্তম গন্তব্য এবং রেমিট্যান্সের পঞ্চম বৃহত্তম উৎস। গত বছর কুয়েত থেকে বাংলাদেশি কর্মীরা ১.৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
বেসরকারি হিসাবে, বর্তমানে কুয়েতে প্রায় ৪ লাখ বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ১ লাখ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, কুয়েতগামী বাংলাদেশি অভিবাসীরা সরকার নির্ধারিত অভিবাসন খরচের চেয়ে গড়ে ৪২০.৮ শতাংশ বেশি টাকা পরিশোধ করেছেন।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট এবং দৃষ্টি রিসার্চ সেন্টারের পরিচালিত ওই জরিপে উঠে আসে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে কুয়েতে অভিবাসী ২৯২ জন পুরুষ গড়ে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন, যা সরকার নির্ধারিত ১ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকার অভিবাসন ফি থেকে ৫২৫ শতাংশ বেশি।
Loading...
বন্ধ হয়েছিল সৌদি ওয়ার্ক ভিসা জালিয়াতি
২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগকারী এজেন্টরা অভিযোগ করেন, ওয়ার্ক ভিসা নিশ্চিত করতে তাদের মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে সৌদি দূতাবাসকে প্রতি আবেদনের জন্য ২২০-২৫০ ডলার ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে’ দিতে বাধ্য করা হতো। অন্যথায়, ভিসা জারি করা হতো না।
ফলে সৌদিগামী বাংলাদেশি কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা বেড়ে যায়, কারণ নিয়োগকারী সংস্থাগুলো এ অতিরিক্ত খরচ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। ২০২৩ সালের মার্চে সৌদি কর্তৃপক্ষ ১৫৪ কোটি টাকার ভিসা দুর্নীতির অভিযোগে ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের দুই প্রাক্তন কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
Loading...
স্থানীয় নিয়োগ সংস্থাগুলো জানায়, এ ঘটনা প্রকাশের পর দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গেছে এবং সৌদি দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের অভিযান এ কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
আরও পড়ুন
Loading...
