প্রবাসীদের ভোগান্তির আরেক নাম দূতাবাস

Loading...

প্রবাসীদের ভোগান্তির আরেক নাম দূতাবাস

চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার বাসিন্দা ইমরান হোসেন। নিজের কর্মস্থল মালয়েশিয়ার কলাং শহরের একটি কারখানা থেকে এক দিনের ছুটি নিয়ে গত ২ জানুয়ারি তিনি পাসপোর্ট নবায়ন করতে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়েছিলেন।

কাতারে বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন চাকরির খবর

সেখানে সারা দিন অপেক্ষা করেও পাসপোর্ট নবায়ন করতে সক্ষম হননি তিনি। কালের কণ্ঠকে ইমরান হোসেন বলেন, ‘গত ২ জানুয়ারি সকাল ৬টার দিকে আমি পাসপোর্ট নবায়ন করতে হাইকমিশনে যাই।

Loading...

ব্যাংক ড্রাফট করে ওয়েটিংরুমে অপেক্ষায় থাকি। সকাল ১১টার দিকে একজন স্যার আসেন। তিনি সবার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন। যাচাই-বাছাই শেষে আবার অপেক্ষা করতে বলেন।

আরো বলেন, আরেকজন স্যার আসার পর সবার পাসপোর্ট জমা নেবেন। আমিসহ অন্যরা ওই স্যারের অপেক্ষায় থাকি। এভাবে আরো পাঁচ ঘণ্টা পার হলে বিকেল ৪টার দিকে ওই স্যার সবাইকে পাসপোর্ট জমা দিতে ডাকেন। তখন তিনি সবাইকে জানান, পাসপোর্টের সঙ্গে জন্ম নিবন্ধন কার্ড লাগবে।

এ ছাড়া পাসপোর্ট জমা নেওয়া হবে না। কিন্তু হাইকমিশনের পেজে বলা হয়নি যে এমআরপি পাসপোর্ট করতে জন্ম নিবন্ধন কার্ড লাগবে। এ কারণে কেউ সঙ্গে করে জন্ম নিবন্ধন কার্ড নেয়নি। এখন আবার জন্ম নিবন্ধনের কপি নিয়ে নতুন করে পাসপোর্ট জমা দিতে হবে।

হয়তো ওই সময়ও তাঁর দেখা পেতে পুরো দিন সময় লাগবে। তিনি আরো বলেন, ‘সকাল ৬টা বাজে দূতাবাসে গিয়ে কারখানায় ফিরে আসতে রাত ১০টা। প্রতিদিন ছুটি নিয়ে এভাবে তো দূতাবাসে যাওয়া সম্ভব নয়।’

কাতারের সব আপডেট হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন

মালয়েশিয়ায় হাইকমিশনে সারা দিন অপেক্ষা করে ইমরান হোসেন ফিরে এলেও যাঁরা দালালের মাধ্যমে কাজ করেছেন, তাঁদের ফিরে আসতে হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

ইমরান বলেন, ‘সকাল ৬টায় ট্যাক্সি থেকে হাইকমিশনে নামতেই কয়েকজন দালাল আমাকে ঘিরে ধরে। তারা আমাকে পাসপোর্ট করে দেওয়ার কথা বলে। বিনিময়ে ৪০০ রিঙ্গিত দাবি করে।

Loading...

আমি দালালকে পাসপোর্ট না করতে দিয়ে নিজেই হাইকমিশনে যাই। সেখানে ব্যাংক ড্রাফট করে ওয়েটিংরুমে অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু যাঁরা দালালকে টাকা দিয়ে ব্যাংক ড্রাফট করেন তাঁরা আগে সিরিয়াল পান।

আর দ্রুত পাসপোর্ট জমা দিয়ে চলে যান। কিন্তু আমাকে আর সিরিয়াল দেওয়া হয় না। বসিয়ে রাখা হয় দীর্ঘ সময়।’ ইমরানের মতো বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে এভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রবাসী কর্মীরা।

পাসপোর্ট নবায়ন, কল সেন্টার, কর্মী সত্যায়ন, কারখানায় তদারকিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে প্রবাসী কর্মীদের। তাঁরা বলছেন, দূতাবাসের অসহযোগিতার কারণে বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তাঁরা।

Loading...

এদিকে দূতাবাসের কর্মকর্তারা প্রচলিত সেই কথাই বলছেন, জনবলসংকটের কারণে অনেক সময়ই প্রয়োজনীয় সেবা দিতে ব্যর্থ হন তাঁরা। তবে তাঁদের আন্তরিক চেষ্টা থাকে প্রবাসী কর্মীদের সেবা প্রদানে।

দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতার কথা স্বীকার করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।

গত ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বিদেশে দূতাবাসে আমাদের কর্মীদের প্রচুর হয়রানির শিকার হতে হয়।

Loading...

একদম আমার নিজের ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি যে আমাদের দূতাবাসগুলো প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না।’ কর্মীরা সহজে দূতাবাসে যোগাযোগ করতে পারেন না

কর্মীদের নানা ভোগান্তির বিষয়ে দূতাবাস কিংবা হাইকমিশনে কথা বলার জন্য প্রতিটি দূতাবাসে কল সেন্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের মূল শহরে অল্পসংখ্যক কর্মী বসবাস করেন।

বেশির ভাগ কর্মীর কর্মস্থল শহরের বাইরে। ফলে তাঁদের পক্ষে সব সময় মূল শহরে আসা সম্ভব হয় না। এ জন্য তাঁরা ফোনের মাধ্যমে দূতাবাসগুলোর সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করতে চান।

Loading...

তবে শুধু সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে দূতাবাসে দুটি করে কল সেন্টার রয়েছে। বাকিগুলোতে একটি করে কল সেন্টার রয়েছে। কর্মীরা বলছেন, এই কল সেন্টার সব সময় ব্যস্ত থাকে। সারা দিন ফোন করলে সহজে কানেক্ট করা সম্ভব হয় না।

দুর্ব্যবহারের অভিযোগ

শুধু ফোন সংযোগ নয়, দূতাবাস কিংবা হাইকমিশনে গেলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রবাসী কর্মীদের। তাঁদের ভাষ্য মতে, প্রতিটি দূতাবাসে চার-পাঁচটি ছোট ছোট কাউন্টার রয়েছে। এই কাউন্টারে বসা কর্মকর্তারা প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

Loading...

গ্রাম থেকে কাজ করতে যাওয়া বেশির ভাগ কর্মী অনেক কিছু না বোঝার কারণে দূতাবাসে যান। তাঁরা ওই কাউন্টারগুলো থেকে তথ্য নেন। ফলে বাড়তি প্রশ্ন করলে বিরক্ত হন কর্মকর্তারা।

বিদেশি লোকবল নিয়োগ

দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলোতে বাংলাদেশি লোকবলের পাশাপাশি বিদেশি লোকবলও নিয়োগ দেওয়া হয়। এই বিদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ভাষার কারণে বাংলাদেশি কর্মীরা সহজে কথা বলতে পারেন না।

প্রবাসী কর্মীরা দাবি জানিয়েছেন, বিদেশি কর্মীদের সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশিদের নিয়োগ দিতে পারে দূতাবাস। তাহলে কর্মীদের কথা বলা সহজ হবে।

Loading...

কারখানা পরিদর্শনে রয়েছে অনীহা

বাংলাদেশ থেকে বিদেশের মাটিতে কাজ করতে যাওয়া অনেক কর্মী সঠিক চাকরি, পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক, ঠিক সময়ে বেতন থেকে বঞ্চিত হন। এ ছাড়া কর্মীদের কাজ না পাওয়া থেকে শুরু করে রয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ। এর ফলে অনেক কর্মীকে খালি হাতে দেশে ফিরে আসতে হয়।

তাঁদের এই ভোগান্তির জন্য দূতাবাসকে দায়ী করছেন কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, দূতাবাস কিংবা হাইকমিশন থেকে কখনো কারখানায় গিয়ে প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলা হয় না। কর্মীরা ঠিকমতো কাজ পাচ্ছেন কি না, তাঁরা ঠিকমতো বেতন পান কি না, কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয় না।

Loading...

তবে দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো দেশের দূতাবাস বা হাইকমিশনের পক্ষে শতভাগ যাচাই-বাছাই করে কর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে দূতাবাস বা হাইকমিশনকে আবশ্যিকভাবে দেশটির কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মালয়েশিয়া হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশ হাইকমিশনগুলো ৫ শতাংশ চাহিদার বিপরীতে নিয়োগকর্তার অফিস বা প্রজেক্ট সাইট ভিজিট করে থাকে।

বাকি ৯৫ শতাংশ দেশের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সঠিক আছে কি না, সেসংক্রান্ত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে চাহিদাপত্র সত্যায়ন করে থাকে। হাজার হাজার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে ভিজিট করা হাইকমিশনের পক্ষে বাস্তবিক অসম্ভব।

Loading...

এটি দেশগুলোর শ্রমিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব। তাই দেশগুলোর শ্রমিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্রের ওপর আস্থা রেখে শ্রমিক পাঠানোর কাজ করে থাকে হাইকমিশন।’

দূতাবাসে কর্মীদের হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ের লোকজন কিন্তু বেশি দূতাবাসে নেই। মাত্র ২৭টি দূতাবাসে রয়েছে।

Loading...

সেখানেও একজন করে, কোনো কোনো দূতাবাসে দুজন করে রয়েছে। দূতাবাসের জনবল নিয়োগের কাজটি প্রধানত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আমরা আমাদের জায়গা থেকে এই হয়রানি বন্ধের জন্য ব্যবস্থা করে আসছি।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও কাজ করছে। তবে সব কিছুর মূলে প্রয়োজন মানসিক চিন্তার পরিবর্তন। মানসিক চিন্তার পরিবর্তন না ঘটলে কোনো কিছুর পরিবর্তন ঘটবে না।’

কালের কণ্ঠ

Loading...

Loading