১১ মাসে প্রবাসে ৩,২২২ কর্মীর মৃত্যু, নিঃস্ব অনেকে

পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে দেশ থেকে ধারদেনা করে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সৌদি গিয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের ফাতেমা বেগম।

চলতি বছরের ৪ঠা অক্টোবর লাশ হয়ে দেশে ফেরেন। লাশের সঙ্গে আসা প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা।

কাতারের সব খবর হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন

কিন্তু তার শরীরজুড়ে ছিল   আঘাতের চিহ্ন। যেটা দেখে মনে হয়েছে- তার উপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে, এমনটিই দাবি নিহত ফাতেমার স্বামী শের আলীর।

স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় চাকরিদাতা এজেন্সির পক্ষ থেকে প্রথমে ১২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের লোভ দেখিয়ে লাশ দেশে নেয়ার দরকার নেই বলে জানায়।

পরবর্তীতে শ্রম কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরে অনেক চেষ্টায় প্রায় ১৫ দিন পর ফাতেমার লাশ দেশে পাঠানো হয়।

কাতারে চাকরি খুঁজছেন? এখানে ক্লিক করুন

ভাই-বোন এবং বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের যুবক রুকন উদ্দিন সৌদি আরব গিয়েছিলেন ২০১৮ সালে।

অসুস্থ অবস্থায় চলতি বছরের ১০ই অক্টোবর দেশে ফেরার সময় বিমানেই তার মৃত্যু হয়। যদিও ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাশের সঙ্গে আসা প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

মৃত্যুর ৫ দিন আগে রুকনের সঙ্গে পরিবারের শেষ কথা হয়। গত নভেম্বরে দেশে ফিরবেন বলে জানান। এর ৩ দিন পর সিলিন্ডার গ্যাস বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন রুকন। পরে তার এক রুমমেট দেশে ফোন করে বিষয়টি পরিবারকে জানান।

এরপর তাকে অসুস্থ অবস্থায় দেশে পাঠালে বিমানেই তার মৃত্যু হয়। ভাগ্য বদলাতে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন বগুড়ার কাহালুর সুমন আহমেদ।

মাত্র ২১ বছর বয়সে যেখানে পড়ালেখা করার কথা সেখানে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। দেশে লাশের সঙ্গে আসা সনদে উল্লেখ ছিল স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

একইভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের আবদুল বাছির ও নবীনগরের নুরুল ইসলামের ২২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় সৌদি আরবে।

তাদের প্রত্যেকেরই হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাশ আসে ২ হাজার ৮৪৭ প্রবাসীর।

এরমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচ দেশে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৯৮৭ জনের। সৌদি আরবেই মারা যান ১ হাজার ১৯৩ জন। কুয়েতে মারা যান ২০৪ জন, আরব আমিরাতে ২৪৭ জন, কাতারে ১২৩ জন ও ওমানে ২২০ জন।

সরকারি হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে অর্থাৎ ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ২২২ জন প্রবাসীর লাশ দেশে এসেছে।

এ ছাড়া গত ৩০ বছরে বিদেশে ৪৬ হাজার ৫০৩ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ২ হাজার ৪২২ জনের বয়স ১৯ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।

মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রতিকূল পরিবেশ, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের কথা বলা হয়েছে। প্রবাসে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার এসব শ্রমিকের বেশিরভাগই বয়সের দিক দিয়ে তরুণ।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও তিন বিমানবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে ৩৩ হাজার ৯৯৮ প্রবাসী শ্রমিকের বিদেশে মৃত্যু হয়েছে।

২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এক হাজার ৭৪৫ জন প্রবাসীর মরদেহ এসেছে। তাদের ২০ দশমিক ১২ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে।

যেসব মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলা হচ্ছে, সেগুলোও সন্দেহমুক্ত নয়। অপমৃত্যুর শিকার কর্মীদের গড় আয়ু আরও কম। বাংলাদেশে অভিবাসন খাত নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, প্রবাসে মারা যাওয়া শ্রমিকদের বড় একটি অংশের মৃত্যু ঘটে স্ট্রোকে।

এরপর রয়েছে হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যা। কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু ও সড়ক দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, আগুনে পুড়ে মৃত্যু, আত্মহত্যা বা খুন।

প্রবাসীদের এমন আকস্মিক মৃত্যুর কারণ দেশ থেকে যাচাই করা হয় না। ফলে লাশের সঙ্গে আসা মেডিকেল রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয় সেটাই চূড়ান্ত হিসেবে ধরা হয়।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৭০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে কাজ করেন। এ হিসাবে ২০২২ সালে হাজারে ৫ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে বিদেশে।

বিদেশে চাকরিতে যান সাধারণ ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা। তারা দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হন। কর্মক্লান্তিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা পান না।

কর্মীদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করতে বাধ্য করা হয়। সুষম খাবার না পাওয়া, কর্মীরা চার-পাঁচ গুণ বেশি টাকা খরচ করে বিদেশ যাওয়া, চড়া সুদে ঋণ এবং জমি বিক্রি করে বিদেশ যাওয়া।

সেখানে গিয়ে প্রতারিত হয়ে চাকরি ও বেতন না পাওয়াসহ সবসময় মানসিক চাপে ও দুশ্চিন্তায় থাকেন। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক সূত্র জানায়, বিদেশের সংশ্লিষ্ট দূতাবাস থেকে যে অনাপত্তিপত্র (এনওসি) ইস্যু করে এবং সেখানে যা উল্লেখ থাকে হুবহু তাই লিখে দেয়া হয়।

দূতাবাসের নথিতে এসব বেশির ভাগ মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে প্রচ- গরমে প্রতিকূল পরিবেশে অদক্ষ এই বাংলাদেশিরা ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকেন।

একদিকে প্রতিকূল পরিবেশ, আরেকদিকে অমানুষিক পরিশ্রম, ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপের কারণেই সাধারণত স্ট্রোক বা হৃদরোগের মতো ঘটনা ঘটে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির ইনফরমেশন কর্মকর্তা মো. নয়ন মানবজমিনকে বলেন, অধিকাংশই মৃত্যুর ঘটনা স্ট্রোকে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।

বয়সের দিক দিয়ে তরুণ এবং মধ্যবয়সী। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও অন্যান্য দুর্ঘটনায়, আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কারণগুলো ঘুরেফিরে প্রায় একই রকম।

তিনি বলেন, এসব অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য কাজের পরিবেশ ভালো না হওয়া, উচ্চাভিলাষী বেতন তুলতে গিয়ে মানসিক চাপ, বিষণœতা, পারিবারিক অশান্তিসহ নানান কারণ দেখা গেছে।

চলতি বছরের ১১ মাসে মৃত অভিবাসীদের মধ্যে ১০৩ জন ছিল নারী। নিয়োগকর্তারা তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে আত্মহত্যা উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বাসা-বাড়ির মালিকদের শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতনসহ নানা কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

এ ধরনের অস্বাভাবিক মৃত্যু কমাতে ব্রাকের পক্ষ থেকে টেলিকাউন্সিলিং সেবা চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রবাসী নারী-পুরুষদের বিভিন্নভাবে কাউন্সিলিং করা হয়।

এ ছাড়া মৃত্যুর পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করে মন্ত্রণালয়ে নীতিমালা আকারে তুলে ধরতে ব্র্যাক কাজ করছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

আরও খবর পড়ুন

মানবজমিন

Loading...
,