প্রবাসীদের ঋণ পেতে বাধা ‘সুপারিশ কমিটি’
Loading...
প্রবাসীদের ঋণ পেতে বাধা ‘সুপারিশ কমিটি’
করোনা মহামারির কারণে বা তার আগে বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা বেশিরভাগ প্রবাসীর জীবিকা সংকটে রয়েছে। সংকট দূর করতে সরকারের উদ্যোগে ঋণ দেওয়া শুরু হলেও অনেক প্রবাসী বিষয়টি জানেন না।
যারা বিষয়টি জেনে ঋণ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন তারাও সেই অর্থে সুফল পাচ্ছেন না। বরং ঋণ পাওয়া নিয়ে নানা ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাদের।
কাতারের সব আপডেট পেতে জয়েন করুন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে
Loading...
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বেধে দেওয়া বাছাই বা সুপারিশ কমিটি।
সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও এ কমিটিতে থাকা পাঁচ সদস্যের সুপারিশ নিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক কর্মকর্তাদের। অর্থাৎ সব কাজ শেষ হলেও ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংক। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ঋণপ্রত্যাশী প্রবাসীরাই।
গত ১৫ জুলাই থেকে প্রবাসীদের ঋণের আবেদন সংগ্রহ করছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। এ ঋণ দেওয়ার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে একটি বাছাই কমিটি গঠন করা হয়।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) সভাপতি করে একজন কৃষি কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এবং যেসব জেলা বা উপজেলায় জনশক্তি ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অফিস রয়েছে সেখানকার সহকারী পরিচালককে সদস্য করে গঠন করা হয় সুপারিশ কমিটি।
করোনায় চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরা বেশ কয়েকজন ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’র সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সব নিয়ম-কানুন পরিপূর্ণ করার পরও সুপারিশ কমিটির আন্তরিকতার অভাবে ঋণ পেতে অনেক ক্ষেত্রে মাস বা তার চেয়েও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা ছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে সুপারিশ কমিটির প্রধান ইউএনও’র সঙ্গে বার বার দেখা করেও সুপারিশ না মেলায় ঋণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন প্রবাসী।
তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কিছু শাখায়। সুপারিশ কমিটির প্রধানের আন্তরিকতায় খুব সহজেই কিছু প্রবাসী ঋণ পাচ্ছেন— এমনটাই জানিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা ও ঋণ পাওয়া প্রবাসীরা।
করোনায় চাকরি হারানো দুবাইফেরত এক প্রবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি যে, কারও কাছে চাইতে পারছি না। কীভাবে বউ-বাচ্চা নিয়ে দিন পার করছি সেটাও বোঝাতে পারব না।
ঋণের জন্য মাসখানেক আগে আবেদন করেছি। সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও ইউএনও স্যারের সাইন না পাওয়ায় ব্যাংক আমাকে ঋণ দিতে পারছে না।’
Loading...
জানা যায়, ফিরে আসা কর্মীদের পুনর্বাসনে ৭০০ কোটি টাকার তহবিল তৈরি করেছে সরকার। ঋণসহায়তা দিতে গত জুলাইয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তহবিলে আরও ৫০০ কোটি টাকা যুক্ত হবে। এ তহবিল থেকে প্রবাসী পুনর্বাসন ঋণ নামে ৪ শতাংশ সরল সুদে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পাবেন প্রবাসীরা।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের বেশ কয়েকটি শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুপারিশ কমিটির প্রধান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সময়, আন্তরিকতা ও কাগজপত্রের ক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ম-কানুনের বাইরে বিভিন্ন শর্ত দিচ্ছেন তারা।
এসব কারণে ব্যাংকের ছাড়পত্র পেলেও সংশ্লিষ্ট কমিটির সুপারিশ পেতে মাস কিংবা তারও বেশি সময় ঘুরেও ঋণ পাচ্ছেন না অনেক প্রবাসী।
ঋণ পেতে প্রবাসীদের পাসপোর্টের কপি, আগমন-বহির্গমনের সিলযুক্ত পাতা, যে দেশে ছিলেন সেখানকার বৈধ আইডি কার্ড বা ভিসার কপি অথবা বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে ম্যানপাওয়ার করে গেছে তার কপি দিতে হচ্ছে প্রবাসীদের।
এসব প্রক্রিয়া শেষ করার পর প্রবাসীদের ব্যাংকে জানাতে হচ্ছে কী কারণে বা কোন ব্যবসা করার জন্য তিনি ঋণ নিচ্ছেন। ব্যবসা করতে হলে প্রবাসীদের ট্রেড লাইসেন্সের কপি দিতে হচ্ছে। এটার সঙ্গে দিতে হচ্ছে ছয় মাসের আয়-ব্যয়ের বিবরণীও।
কাতারে চাকরি খুঁজছেন? এখানে দেখুন চাকরির খবর
Loading...
এতসব নিয়ম পরিপূর্ণ করার পরও ঋণ পেতে প্রবাসীদের আরও কিছু কাগজপত্র যোগ করতে বলছেন কিছু কিছু ইউএনও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সুপারিশ কমিটি না করে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে প্রক্রিয়া সহজ হতো।
বিশেষ করে ইউএনওরা সময় দিতে পারছেন না বলে বিভিন্ন শাখা থেকে ব্যাংক কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন। ব্যাংক থেকে খুব কম সময়ে সব কার্যক্রম শেষ করে দিলেও তাদের কমিটির সুপারিশ পেতে দেরি হওয়ায় প্রবাসীদের কম সময়ে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’
তবে কমিটির ভালো দিক হিসেবে এ ব্যাংক কর্মকর্তার ভাষ্য, সুপারিশ কমিটি করায় ঋণ উদ্ধারের বিষয়টি সহজ হবে।
বিষয়টি নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ২০০ কোটি টাকা থেকে নগদ ১৫ কোটি টাকা পেয়েছে।
এ অর্থ থেকে মোট ৩৯০ জনকে সাত কোটি ৬৬ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংক। এ ঋণের ক্ষেত্রে প্রবাসীদের শতকরা চার ভাগ সুদ দিতে হচ্ছে।
Loading...
অন্যদিকে সরকারের ৫০০ কোটি টাকার ঋণ প্রকল্পের মধ্যে ২৫০ কোটি টাকা বুঝে পেয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। পাওয়া অর্থ থেকে ৬৮২ প্রবাসীকে ১২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পুরুষদের শতকরা নয় শতাংশ এবং নারীদের সাত শতাংশ হারে সুদ দিতে হচ্ছে।
করোনায় চাকরি হারিয়ে বা চলতি বছরের শুরুর দিকে দেশে ফিরে জীবিকা সংকটে থাকা বেশ কয়েকজন প্রবাসী জানান, সরকার যে তাদের জন্য ঋণ দিচ্ছেন সেটাই তারা জানতেন না।
সৌদিফেরত কচুয়ার বাসিন্দা আবদুল মতিন বলেন, ‘সরকার ঋণ দিচ্ছে এটা তো আমরা জানিই না। অথচ পরিবার-পরিজন নিয়ে আমরা কত কষ্টে জীবন পার করছি। সবাই তো মনে করে বিদেশ ছিল, টাকার অভাব নাই। অথচ আমরা শূন্য হাতে দিন পার করছি।’
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদের সহকারী একান্ত সচিব মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, প্রবাসফেরতদের জন্য সরকারের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারা নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এদিকে অভিবাসীদের জন্য সরকারের চলমান এ ঋণ প্রকল্পের সাধুবাদ জানিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনাকালে দেশে ফিরে আসা অভিবাসীদের সহযোগিতার সদিচ্ছা সরকারের রয়েছে। তবে চলমান এ ঋণ প্রক্রিয়া এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি বলে মনে করছেন তারা।
Loading...
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যারা এটা পাওয়ার যোগ্য সেই মানুষগুলো ঠিকমতো জানেই না যে সরকার তাদের কিছু একটা দিচ্ছে। সরকার যদি মনে করে আমরা অপেক্ষা করি, যাদের দরকার তারা আসবে, সেটা হলে আরও অনেক সময় লেগে যাবে।
তাছাড়া করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে ফেরাদের কংক্রিট কোনো ডাটাবেজ নাই। কিন্তু এ তথ্যগুলোর কংক্রিট ডাটাবেজ থাকা উচিত ছিল। সুপারিশ কমিটির প্রধান ইউএনওরা হয়তো এটা তাদের একটা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দেখছেন।
হয়তো তারা মনে করছেন, এটা নিয়ে তাদের বাধ্যবাধকতা নেই। তারা বলতে পারেন, আমরা করব, কিন্তু সময় দিতে পারছি না। বিষয়টিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকলে প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে এই অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, “এটা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।
এটাকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে ইউএনওদের লাইন মিনিস্ট্রির সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটা অফিস অর্ডার দেওয়া যায় যে, ‘এটাকে জরুরিভিত্তিতে দেওয়া’। তাছাড়া লেবার মাইগ্রেশনের জন্য একটা উচ্চপর্যায়ের কমিটি রয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।”
Loading...
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ঋণ প্রকল্পের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ১১ কোটি টাকার তাৎক্ষণিক খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে বিতরণ করেছে সরকার।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ২৯ দেশ থেকে তিন লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ বাংলাদেশিকর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। তাদের মধ্যে ৩৯ হাজার ২৭৪ জন নারীকর্মীও রয়েছেন।
Loading...