পাসপোর্টের ইতিকথা: লাল, নীল কিংবা সবুজ বইটি যেভাবে এল
Loading...

পাসপোর্টের ইতিকথা: লাল, নীল কিংবা সবুজ বইটি যেভাবে এল
নীল, সবুজ কিংবা লাল প্রচ্ছদের ছোট একটি বই—হাতে থাকলেই যেন খুলে যায় সীমানাহীন পৃথিবীর দরজা। আটলান্টিকের ওপার, আরবের মরুভূমি, ইউরোপের পুরোনো শহর কিংবা হিমালয়ের পাদদেশ—সব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি লুকিয়ে থাকে এই ক্ষুদ্র নথিতে।
পাসপোর্ট একই সঙ্গে পরিচয়পত্র, আবার আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ‘চাবি’। কিন্তু এই নথি কীভাবে মানুষের জীবনে এলো?
পাসপোর্ট আসলে কেবল ভ্রমণের কাগজ নয়—এটি মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাস, যুদ্ধ, শাসন, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি দীর্ঘ বিবর্তনধারা। মধ্যযুগের ইউরোপীয় পর্যটকদের হাতে যে ভ্রমণ নথি দেখা যেত, তারও বহু আগে রোমান সাম্রাজ্য ও প্রাচীন চীনে চলাচলের অনুমতিপত্র ব্যবহৃত হতো।
কাতারের সব আপডেট হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন
Loading...
যদিও আধুনিক পাসপোর্ট খুব বেশি দিনের পুরোনো নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বিশ্বের সীমান্তগুলো আবার নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসে, তখনই ছোট্ট এই নথিটি ধীরে ধীরে রূপ নেয় আন্তর্জাতিক ভ্রমণের অপরিহার্য পরিচয়পত্রে। কীভাবে একটি কাগজ বিশ্বরাজনীতির অংশ হয়ে উঠল—সেই ইতিহাসই এখানে তুলে ধরা হলো।
ভ্রমণের প্রাচীন অনুমতিপত্র
পাসপোর্টের শেকড় বহু পুরোনো। চীনের প্রাচীন রাজবংশগুলো থেকেই শুরু এ নথির ইতিহাস। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭৫–২২১ সালের ঝৌ রাজবংশের সময়ে যুদ্ধাবস্থার কারণে গুয়োসৌ নামে একটি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু ছিল। কোথায় কে যাচ্ছে—তা জানার জন্য কাঠের তৈরি অনুমতিপত্র সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক ছিল। পরে হান রাজবংশের (খ্রিষ্টপূর্ব ২০২–২২১) সময়ে এ ব্যবস্থায় আরও কড়াকড়ি আসে।
কাতারে বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন চাকরির খবর
Loading...
সিল্করোডের বণিকরাও এসব অনুমতিপত্র দেখিয়ে তল্লাশিচৌকি পার হতেন। ফলে গুয়োসৌ ছিল একই সঙ্গে পরিচয়পত্র, যাত্রার অনুমতি ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের উপায়। কাঠের সেই নথি অনেকটাই আধুনিক পাসপোর্ট কিংবা ভিসার মতো ছিল।
রোমান সাম্রাজ্যেও সরকারি কাজে ভ্রমণকারীদের জন্য ‘ট্র্যাক্টরিয়াম’ নামে চিঠি দেওয়া হতো—যা ছিল নিরাপদ যাত্রার অনুমতিপত্র। আর অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যদের পরিচয় নিশ্চিতে দেওয়া হতো ‘ডিপ্লোমা’, একটি বিশেষ ধাতব নথি।
ফেসবুকে আমাদের সাথে থাকতে লাইক দিন এখানে
Loading...
মধ্যযুগে নিরাপদ যাত্রার সেফ কন্ডাক্ট
ইউরোপে মধ্যযুগে ছড়িয়ে পড়ল বাণিজ্য, তীর্থযাত্রা ও কূটনৈতিক যোগাযোগ। তখনই গুরুত্ব পেল ‘সেফ কন্ডাক্ট’ নামের অনুমতিপত্র। এতে ভ্রমণকারীর নাম, উদ্দেশ্য ও ভ্রমণপথ উল্লেখ থাকত—নীচে থাকত রাজা বা সম্রাটের সিল। এটি ছিল নিরাপদ চলাচলের প্রতিশ্রুতি।
স্পেনের আরাগো–কাতালোনিয়া অঞ্চলে বণিকদের দেওয়া হতো ‘গুইডাটিকাম’; ফ্রান্সে ব্যবহৃত হতো ‘সো কনডুইও’। নিরাপদ বাণিজ্য ও রাজনৈতিক যোগাযোগ এ নথির মূল উদ্দেশ্য। ইংল্যান্ডে ১৪১৪ সালে রাজা পঞ্চম হেনরির শাসনামলে সেফ কন্ডাক্ট ব্যবস্থার প্রথম আনুষ্ঠানিক উল্লেখ পাওয়া যায়।
এ সব নথি আধুনিক পাসপোর্টের পূর্বসূরি—যা ভ্রমণকারীর সুরক্ষার জন্য শাসকের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিত।
Loading...
পাসপোর্ট নাম হলো যেভাবে
‘পাসপোর্ট’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন দুটি শব্দ থেকে—‘passer’ (পার হওয়া) এবং ‘portus’ (বন্দর/প্রবেশদ্বার)। অর্থাৎ বন্দর বা সীমান্ত পেরোনোর অনুমতিপত্র।
১৫৪০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির আমলে প্রিভি কাউন্সিল আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পাসপোর্ট’ শব্দটির ব্যবহার শুরু করে। ১৬৪১ সালের একটি পাসপোর্ট, যাতে রাজা প্রথম চার্লসের স্বাক্ষর আছে, এখনো বিশ্বের প্রাচীনতম পাসপোর্ট হিসেবে সংরক্ষিত।
১৭৯৪ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে পাসপোর্ট ইস্যুর দায়িত্ব আসে—এর মাধ্যমে আধুনিক পাসপোর্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়।
Loading...
শুরুতে যেমন ছিল আধুনিক পাসপোর্ট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কঠোর হয়। তখনই আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি হয়। ১৯২০ সালে লিগ অব নেশনস আন্তর্জাতিক ভ্রমণের মানদণ্ড নির্ধারণ করে প্রথম বৈশ্বিক পাসপোর্ট কাঠামো চালু করে।
এটির লক্ষ্য ছিল শুধু ভ্রমণ সহজ করা নয়; বরং ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং অভিবাসন ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলায় আনা।
১৯৬৩ সালে জাতিসংঘে পাসপোর্ট সম্পূর্ণ বাতিলের প্রস্তাব ওঠে—কারণ এটি মানুষের চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে প্রস্তাবটি আটকে দেয়।
Loading...
আজকের পাসপোর্ট: স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণ একসঙ্গে
আজ আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, কাজ, শিক্ষা, বাণিজ্য—সব কিছুর জন্য পাসপোর্ট অপরিহার্য। ডিজিটাল পাসপোর্ট, বায়োমেট্রিক তথ্য ও ই-পাসপোর্ট যুক্ত হওয়ায় এটি এখন আরও নিরাপদ।
তবে পাসপোর্টের রয়েছে এক অদ্ভুত দ্বৈততা—একদিকে এটি বিশ্বভ্রমণের স্বাধীনতা দেয়, অন্যদিকে রাষ্ট্রের নজরদারি ও চলাচল নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার।
এক সময় কাঠের ছোট অনুমতিপত্র থেকে শুরু করে আজকের বায়োমেট্রিক ই-পাসপোর্ট—এই দীর্ঘ যাত্রাপথই বলে দেয়, পাসপোর্ট শুধু একটি বই নয়; এটি মানবসভ্যতার এক যুগ থেকে আরেক যুগে অগ্রগতির নীরব সাক্ষী।
আরো পড়ুন
Loading...






