কুকুর লেলিয়ে পুরুষ ফিলিস্তিনিকে ধর্ষণ—বিবিসির প্রতিবেদনে ইসরায়েলি কারাগারে নির্যাতনের চিত্র
Loading...

কুকুর লেলিয়ে পুরুষ ফিলিস্তিনিকে ধর্ষণ—বিবিসির প্রতিবেদনে ইসরায়েলি কারাগারে নির্যাতনের চিত্র
ইসরায়েলের বন্দিশিবিরে ফিলিস্তিনি কয়েদিদের ওপর কেমন অকথ্য নির্যাতন আর যৌন নিগ্রহ চলছে, তার প্রমাণ মিলল দুজনের অভিজ্ঞতায়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে বন্দী নির্যাতনের যে হাড় হিম করা বিবরণ উঠে এসেছে, তাঁরা নিজেরাই তার শিকার।
কাতারের সব আপডেট হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন
Loading...
গত মাসে জাতিসংঘের কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার তাদের গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল। তাদের মতে, ইসরায়েলি জেলগুলোতে ফিলিস্তিনি বন্দীদের ওপর যে সুপরিকল্পিত এবং ব্যাপক নির্যাতন চলছে, তা এখন কার্যত ‘রাষ্ট্রীয় নীতিতে’ পরিণত হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে হামলার পর থেকে এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বেড়েছে বহুগুণ। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও একে একটি ‘পদ্ধতিগত’ প্রথা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
Loading...
ইসরায়েল অবশ্য সরকারিভাবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু অধিকারকর্মীদের দাবি, ৭ অক্টোবরের সেই রক্তক্ষয়ী হামলা আর গাজায় আটকে থাকা জিম্মিদের দুরবস্থা নিয়ে ইসরায়েলি নাগরিকদের ভেতর যে তীব্র আক্রোশ জন্মেছে, তার সুযোগ নিচ্ছে ইসরায়েলি কারা কর্তৃপক্ষ।
একধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি সেখানে জেঁকে বসেছে, বিশেষ করে যারা হামাসকে সামান্যতম সমর্থন জুগিয়েছে, তাদের ওপর নেমে আসছে পৈশাচিক নিগ্রহ।
Loading...
গত বছর একটি সামরিক কারাগারের সিসিটিভি ফুটেজ ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়। সেখানে দেখা যায়, গাজার এক ফিলিস্তিনি ব্যক্তিকে রক্ষীরা যৌন নির্যাতন করছে।
সেই ঘটনায় ইসরায়েলি সামরিক ও রাজনৈতিক মহলে ছি ছি রব পড়ে যায়, পদত্যাগ করেন বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
৪৬ বছরের সামি আল-সাইয়ি এখন একটি আসবাবপত্রের দোকানে কাজ করেন। কিন্তু একসময় তাঁর পরিচয় ছিল অন্য। অধিকৃত পশ্চিম তীরের তুলকারেম শহরে তিনি সাংবাদিকতা করতেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েলি সেনারা তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর অপরাধ? তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে হামাস বা অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিতেন।
কাতারে বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন চাকরির খবর
Loading...

ইসরায়েলি কারাগারে যৌন নির্যাতনের শিকার সামি আল-সাইয়ি। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
কোনো চার্জশিট বা অভিযোগ ছাড়াই সামিকে ১৬ মাস বন্দী করে রাখা হয়। ইসরায়েলের কুখ্যাত ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিটেনশন’ বা প্রশাসনিক আটক ব্যবস্থার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এ বছরের গ্রীষ্মে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। উত্তর ইসরায়েলের মেগিদ্দো কারাগারে থাকাকালে ২০২৪ সালের ১৩ মার্চ তাঁর ওপর যে অকথ্য নির্যাতন চলে, তার বিবরণ দিতে গিয়ে সামির গলা বন্ধ হয়ে আসে।
সামি জানান, রক্ষীরা তাঁকে বিবস্ত্র করে একটি ব্যাটন বা লাঠি দিয়ে ধর্ষণ করে। রক্ষণশীল ফিলিস্তিনি সমাজে এমন নির্যাতনের কথা স্বীকার করা সামাজিকভাবে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা জেনেও তিনি মুখ খুলেছেন। সামি বলেন, ‘সেখানে পাঁচ-ছয়জন রক্ষী ছিল। তারা অট্টহাসি দিচ্ছিল। এক রক্ষী আমাকে টিটকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল—‘কেমন লাগছে? মজা পাচ্ছো তো? দাঁড়াও, তোমার বউ, বোন, মা আর বন্ধুদেরও এখানে নিয়ে আসব, তাদের সঙ্গেও খেলব আমরা।’
যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকা সামি তখন মনে মনে শুধু মৃত্যু কামনা করছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, মরে গেলেই তো সব শেষ হয়ে যায়। সেই ব্যাটন দিয়ে ধর্ষণের শারীরিক যন্ত্রণার চেয়েও মনের ভেতর যে ধিক্কার জন্মাচ্ছিল, তা সহ্য করা কঠিন ছিল। সঙ্গে ছিল জান্তব নির্যাতন।’
কাতারের সব আপডেট হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন
Loading...
প্রায় ২০ মিনিট ধরে চলা সেই নারকীয় উল্লাসের সময় রক্ষীরা তাঁর যৌনাঙ্গেও প্রচণ্ড আঘাত করেছিল। সামি জানান, জেলের ভেতরে মারধর চলত প্রায় প্রতিদিন, তবে যৌন নিগ্রহ করা হয়েছিল ওই একবার। বিবিসি ইসরায়েল প্রিজন সার্ভিসের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে, তারা একটি দায়সারা বিবৃতি পাঠায়।
সেখানে বলা হয়, তারা আইন মেনেই বন্দীদের দেখাশোনা করে এবং সামির এসব অভিযোগ সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এমনকি এই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়েছে কি না বা সামির কোনো চিকিৎসা-সংক্রান্ত নথি আছে কি না, সেসব প্রশ্নেও তারা নীরব থেকেছে।
Loading...
বন্দী নির্যাতনের অভিযোগ অবশ্য নতুন কিছু নয়। তবে সম্প্রতি সদে তিমান সামরিক কারাগারের একটি ঘটনা গোটা ইসরায়েলকে বিভক্ত করে দিয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গাজার এক বন্দীকে ধারালো কোনো বস্তু দিয়ে যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। এতে ওই ব্যক্তির মলদ্বার মারাত্মকভাবে জখম হয়।
এই ঘটনায় পাঁচজন ইসরায়েলি রিজার্ভ সেনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। গত মাসে তারা টেলিভিশনে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকও করে, যেখানে চারজন সেনা কালো মুখোশ পরে এসেছিল। কেবল একজন তার মুখোশ খুলে বলে, তার কোনো ভয় নেই। তারা সবাই নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করে।
Loading...
দুই বছরে ইসরায়েলি কারাগারে নির্যাতনে নিহত অন্তত ৯৮ ফিলিস্তিনি, গুমের শিকার বহুদুই বছরে ইসরায়েলি কারাগারে নির্যাতনে নিহত অন্তত ৯৮ ফিলিস্তিনি, গুমের শিকার বহু
এই ভিডিওটি ফাঁস করেছিলেন খোদ ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ আইনজীবী মেজর জেনারেল ইফাত তোমের-ইয়েরুশালমি। পরে অবশ্য তিনি পদত্যাগ করেন। তিনি বলেছিলেন, বন্দীদের নিয়ে যারা মিথ্যে প্রচারণা চালাচ্ছে, তাদের স্বরূপ উন্মোচনের জন্যই তিনি এটা করেছিলেন।
Loading...
তবে এই ঘটনা নিয়ে ইসরায়েলি রাজনীতির অন্দরমহলে এখন অন্য হাওয়া বইছে। কট্টর-ডানপন্থীরা ওই অভিযুক্ত পাঁচ সেনার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করছে। এমনকি পার্লামেন্ট বা নেসেটেও এই নিয়ে হয়েছে তুলকালাম।
লিকুদ পার্টির নেতা হ্যানোক মিলউইডস্কিকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, বন্দীকে ধর্ষণ করা কি কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে? তিনি তখন চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘চুপ করো! হামাসের ওই খুনিদের (নুখবা) ওপর সবকিছুই বৈধ। সবকিছুই জায়েজ।’
Loading...
এক জনমত জরিপেও উঠে এসেছে এক ভয়ংকর তথ্য। অধিকাংশ ইসরায়েলি নাগরিক মনে করেন, গাজার বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালালেও সৈন্যদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত করা উচিত নয়।
পশ্চিম তীরের বাসিন্দা আহমেদ (ছদ্মনাম) ১১ সন্তানের বাবা। ৭ অক্টোবরের হামলার সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারে তাঁর এক বছরের জেল আর ৩ হাজার শেকেল জরিমানা হয়। মুক্তির পর তিনি শুনিয়েছেন এক অকল্পনীয় লাঞ্ছনার কথা।
ফিলিস্তিনি তরুণীর মুখে ইসরায়েলি কারাগারের রোমহর্ষক বর্ণনা ফিলিস্তিনি তরুণীর মুখে ইসরায়েলি কারাগারের রোমহর্ষক বর্ণনা
আহমেদ বলেন, ‘তিনজন রক্ষী আমাকে বাথরুমে নিয়ে গেল। পুরো নগ্ন করে আমাকে মেঝেতে শুইয়ে দিল। একজন বিশালদেহী রক্ষী আমার মাথার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, পাছে আমি নড়াচড়া করি। তারপর আমি শুনলাম কেউ একজন একটা কুকুরের সঙ্গে কথা বলছে। কুকুরটার নাম তারা রেখেছিল মেসি।’
আহমেদ এরপর যা বর্ণনা করলেন, তা যেকোনো সভ্য মানুষকে শিউরে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। রক্ষীরা সেই কুকুরটিকে আহমেদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে তাঁকে যৌন লাঞ্ছনা ও অপমানিত করে। আহমেদ বলেন, ‘আমি যত চিৎকার করছিলাম, তারা তত বেশি আমাকে মারছিল। আমি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ মুক্তি পাওয়ার ১২ দিন আগে এই ঘটনাটি ঘটেছিল। আহমেদ জানিয়েছেন, তাঁর কাছে কোনো মেডিকেল রিপোর্ট নেই। কারণ, কারাগারের ভেতরে তাদের কোনো চিকিৎসা দেওয়া হতো না।
বর্তমানে ইসরায়েলি কারাগারগুলোতে বন্দী ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যা ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এদের অনেকের বিরুদ্ধেই কোনো আনুষ্ঠানিক চার্জশিট নেই। জাতিসংঘের রিপোর্টে হামাসের হামলার যেমন নিন্দা করা হয়েছে, তেমনি গভীর উদ্বেগ জানানো হয়েছে ইসরায়েলের গাজায় চালানো হত্যাযজ্ঞ ও বন্দী নির্যাতনের বিষয়ে।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
ফেসবুকে আমাদের সাথে থাকতে লাইক দিন এখানে
Loading...
আরো পড়ুন
Loading...






